ভারতের পাশাপাশি করোনার নতুন ওয়েভের ধাক্কায় বিপর্যস্ত আরও বেশ কিছু এশিয়ান দেশ
ভারতে করোনা বিপর্যয়ের মাত্রা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের ছোঁয়া লেগেছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতেও। এরই মধ্যে কিছু দেশ মহামারির শুরু থেকেই নিজেদের করোনার ভয়াল থাবা থেকে টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বুধবার জানিয়েছে, বিগত সপ্তাহগুলোতে বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণের প্রায় অর্ধেক এবং এক-চতুর্থাংশ মৃত্যুর জন্য ভারতের করোন
কিন্তু ভারতের প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোতেও করোনা সংক্রমণের সংখ্যা আকাশচুম্বী পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দেশটির উত্তরে নেপাল থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণে মালদ্বীপও করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও দ্রুত ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ২৭ লাখ মানুষ নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এবং ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর এই সংখ্যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ১৯ শতাংশ ও ৪৮ শতাংশ বেশি। সংক্রমণের এই উর্ধ্বগতির জন্য বহুলাংশে ভারতই দায়ী।'
হুট করে সংক্রমণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি দেশেরই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে, মেডিক্যাল সাপ্লাইয়ের উপর অত্যন্ত চাপ পড়েছে। কিছু দেশ এরই মধ্যে বিদেশি সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েছে।
বুধবার আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেট ফেডারেশন এশিয়ার এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছে।
শ্রীলঙ্কা
এপ্রিলের মাঝমাঝি সময়ে এসে শ্রীলঙ্কায় কোভিড সংক্রমনের উর্ধ্বগতি দেখা দেয়। প্রথম ওয়েভ চলাকালীন গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাদের যা ক্ষতি হয়েছিল, এবারের সংক্রমণ তাও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
গেল শুক্রবার একদিনে ১৮৯৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রে, এ সংখ্যা এপ্রিলের শুরুর সময়ের সংক্রমণের চাইতে ৫ গুণ বেশি।
শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পবিত্র ওয়ান্নিয়ারাচ্চির মতে, এপ্রিলের ১৩ ও ১ তারিখে শ্রীলঙ্কায় নববর্ষ উপলক্ষে রাস্তাঘাটে ও দোকানপাটে প্রচুর জনসমাগমের ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ তীব্র হয়েছে।
এর আগে শ্রীলঙ্কা নিজেদের কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এমন বিশ্বাস থেকে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎসব পালনের অনুমতি দেয়। ১২ এপ্রিল নতুন বছর উপলক্ষে দেওয়া বার্তায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপাকশে বলেন, 'আমাদের সকলের প্রচেষ্টার ফলে এই বছর আমরা একত্রে নববর্ষ উদযাপন করতে সক্ষম হবো।'
কিন্তু এর পরই এপ্রিলের মাঝামাঝিতে এসে শ্রীলঙ্কায় সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়। ২৭ এপ্রিল দেশটিতে নতুন করে ১,১১১ জন করোনা আক্রান্ত হয়। মহামারি শুরুর পর থেকে এটিই ছিল তাদের একদিনে হাজারের বেশি আক্রান্তের ঘটনা। এরপরই শ্রীলঙ্কা তাদের স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে এবং ১০০টিরও বেশি অঞ্চলে লকডাউন জারি করে।
এই বিধিনিষেধ আরোপের পরও দেশটির সংক্রমণের মাত্রা কমেনি। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে ২৫ টি প্রশাসনিক অঞ্চলের ১৩টি-তেই লকডাউন জারি করেছে।
তবে ভারতের সঙ্গে কাছাকাছি দূরত্বে থাকলেও এখনো পর্যন্ত ভারতের কোভিড ভ্যারিয়ান্ট শ্রীলঙ্কায় পাওয়া যায়নি। তার বদলে দেশটি লন্ডনে প্রথম চিহ্নিত হওয়া B.1.1.7 ভ্যারিয়ান্টকে দায়ী করছে নিজেদের সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য।
বাংলাদেশ ও নেপালের পর শ্রীলঙ্কা সর্বশেষ দেশ হিসেবে বৃহস্পতিবার ভারতের সঙ্গে নিজেদের সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। ভারত থেকে যাত্রীবাহী বিমান ফ্লাইট প্রবেশও নিষিদ্ধ করেছে দেশটি।
মালদ্বীপ
ভারতের আরেক প্রতিবেশি রাষ্ট্র মালদ্বীপে মঙ্গলবার একদিনে রেকর্ড সংখ্যক ৬০১ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে।
পর্যটননির্ভর অর্থনীতির দেশ হওয়ায় মালদ্বীপ আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য গত বছরের জুলাই থেকেই তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছে। অন্যান্য দেশ ভারতের সঙ্গে দ্রুত সীমান্ত বন্ধ করে দিলেও মালদ্বীপে এখনো রিসোর্টগুলো খোলা রয়েছে, বলিউডের তারকারা সেখানে ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন।
এ বছর ভারতীয় পর্যটকরাই মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছেন সবচেয়ে বেশি। জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত ৭০ হাজার ভারতীয় মালদ্বীপে গিয়েছেন। কিন্তু মালদ্বীপের জনসংখ্যার মাত্র ২১ শতাংশ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন এখন পর্যন্ত। ফলে বাকি জনসংখ্যার করোনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
নেপাল
হুট করে ভাইরাসের এই ব্যাপক সংক্রমণের ফলে ভীতিকর হয়ে উঠেছে নেপালের পরিবেশ। ভারতের মত প্রায় একই ভয়াবহ পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দেশটি।
এই মুহুর্তে নেপালে দৈনিক প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ জন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। দুই সপ্তাহ আগে ভারতেও সংক্রমণের মাত্রা একই রকম ছিল।
গেল সপ্তাহেই নেপাল সরকারের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ফেডারেশনের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, নেপালের মোট কোভিড পরীক্ষার ৪৪ শতাংশই পজিটিভ এসেছে বলে জানা যায়। নেপালের পরিস্থিতিকে আশঙ্কাজনক বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
নেপালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ভঙ্গুর এবং ভারতের চেয়েও তাদের মাথাপিছু চিকিৎসকের পরিমাণ কম। দেশটির সাম্প্রতিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, দেশটিতে এখনো যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষা করা হচ্ছে না।
নেপালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র ডা. সামির অধিকারীর মতে, নেপালের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে এবং দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
যদিও নেপাল সীমান্ত প্রহরা জোরদার করেছে এবং রাজধানীসহ বেশি সংক্রামক এলাকাগুলোয় লকডাউন জারি করেছে, কিন্তু দেশটির করোনা সংক্রমণ ইতোমধ্যেই এভারেস্ট বেজ ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।
অনেকেই মনে করছেন ভারতের থেকেই ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন নেপালে পৌঁছে সংক্রমণ বাড়িয়েছে, কারণ ভারতের সঙ্গে নেপালের দীর্ঘ ও প্রায় খোলামেলা সীমান্ত রয়েছে।
যদিও নেপাল এই মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত প্রহরা জোরদার করেছে এবং লকডাউন আরোপ করেছে, তবুও অনেকেই মনে করছেন যে এতে করে শেষ রক্ষা হবেনা। কারণ ইতোমধ্যেই রাজধানী কাঠমান্ডুতে ব্যাপক সংক্রমণ দেখা গিয়েছে।
থাইল্যান্ড
চীনের পর থাইল্যান্ডই প্রথম দেশ হিসেবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলেও, থাইল্যান্ড যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে ২০২০ সালে নিজেদের সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
কিন্তু এ বছর দেশটির সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ওয়েভের সংক্রমণ ছড়ানোর পর এখন তৃতীয় ওয়েভ মোকাবেলার চেষ্টা করছে দেশটি।
সর্বশেষ ওয়েভের সংক্রমণ শুরু হবার আগে ৩১ মার্চ পর্যন্ত থাইল্যান্ডে ২৮,৮৬৩ জন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। পাঁচ সপ্তাহেই সেটি দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে ৭৬ হাজারে পৌঁছে যায়। শুধুমাত্র শুক্রবারেই দেশটিতে ১,৯১১ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় থাইল্যান্ডে রাতের ভেন্যুতে অনুষ্ঠানগুলো বন্ধ করা হয়েছে। গত ৫ এপ্রিল ১৯৬ টি বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝিতে নববর্ষ পালনের ফলে সংক্রমণ আবারও বেড়ে যায়।
করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ খেলার মাঠ ও কেন্দ্র, কনফারেন্স হলগুলোকে হাসপাতালে রূপান্তর করেছে।
মঙ্গলবার ব্যাংককের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ৩০০ জন আক্রান্ত হবার পর সেখানে ৫০ হাজার মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার কার্যক্রম ঘোষণা করেছে থাই সরকার।
ধীর গতির টিকাদান কর্মসূচির জন্য আগেও থাই সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে।
কম্বোডিয়া
ফেব্রুয়ারি পর্যন্তও বিশ্বের সবচেয়ে কম করোনা আক্রান্ত দেশের তালিকায় থাকলেও এখন কম্বোডিয়াতেও সংক্রমণের মাত্রা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। দেশটিতে কোভিডজনিত কারণে কারো মৃত্যু না হলেও, এর পর থেকে ১১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে কোভিডজনিত কারণে।
ফেব্রুয়ারির পর থেকে দেশটিতে সংক্রমণ শুন্যের কোঠা থেকে এক লাফে একশো জনে পৌঁছায়। ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০০ জন, বর্তমানে দেশটিতে মোট করোনা শনাক্তের সংখ্যা ১৭,১৭৯ জন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে কম্বোডিয়া সরকার ১৫ এপ্রিল থেকে রাজধানী ফম পেহতে লকডাউন জারি করেছে। কম্বোডিয়া এই মুহুর্তে চীনা কোম্পানি সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক এর ভ্যাকসিন দিচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়া
এ সপ্তাহের শুরুতে ইন্দোনেশিয়া সরকার জানিয়েছে, দেশটির দু'জন নাগরিকের দেহে ভারতের কোভিড ভ্যারিয়ান্ট পাওয়া গেছে। এই মুহুর্তে ইন্দোনেশিয়ায় দৈনিক গড়ে ৫ হাজার মানুষ কোভিড আক্রান্ত হচ্ছে।
ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করতে 'মুদিক হলিডে' উপলক্ষে ঘরে ফেরা মানুষের ঢল নিয়ে চিন্তিত ইন্দোনেশিয়ার সরকার।
মানুষের এই ভ্রমণ থামাতে সরকার সকল আন্তঃদেশীয় ভ্রমণ ও যানবাহন নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এখনো ঈদ পালন করতে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়া কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ও জনসমাগম বন্ধ করতে সারা দেশে ৯০ হাজার পুলিশ ও ১১,৫০০ সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে।
- সূত্র: সিএনএন