বোরো ধানে কৃষকের উৎপাদন খরচই উঠছে না
প্রচন্ড খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে সেচ খরচ বৃদ্ধি, কৃষি শ্রমিকের বাড়তি মজুরিসহ বিভিন্ন কারণে বোরো ধানের উৎপাদন খরচ এবার বেশি। তবে দাম কম থাকায় ধান বিক্রি করে এই খরচ উঠাতে পারছে না কৃষক।
রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারে খরায় ধানে বাড়তি খরচ হয়েছে ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এক বিঘা (৩৩ শতাংশের হিসেবে) জমিতে সেচের খরচই ১৪০০-১৫০০ টাকা থেকে বেড়ে এবার ২০০০ টাকা ছাড়িয়েছে।
অন্যদিকে অতিখরায় ধানের উৎপাদন কমেছে ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু ধান পরিচর্যা এবং কর্তনে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেশি। সব মিলিয়ে ধানের উৎপাদন খরচই বেড়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা ১ পয়সা। ৪০ কেজি ধরে মণের হিসেব করলে ধানের দাম দাঁড়ায় ১০৪৪ টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অবশ্য বলছে, এবারে খরচ আরো একটু বেশি হয়েছে। তাদের হিসেবে দেখা গেছে, এক কেজি ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা ১৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি মণের দাম পড়ছে ১০৪৭ টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, উৎপাদন খরচ হয়েছে ২৭ টাকা অর্থাৎ প্রতি মণের দাম ১০৮০ টাকা।
কিন্তু বাড়তি খরচ করে উৎপাদন করলেও বাজারে ধান বিক্রি করতে গিয়ে হতাশ হতে হচ্ছে। কারণ ধানের দাম উৎপাদন খরচের তুলনায় কম।
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসেব অনুযায়ী প্রতি মন ধান উৎপাদনে এবার খরচ হয়েছে এক হাজার টাকার বেশি। কিন্তু সারাদেশে ধান বিক্রি হচ্ছে (কম শুকনো) ৭৫০-৮০০ টাকায়। চিকন জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ৯০০-১০০০ (শুকনো) হাজার টাকার মধ্যে। গত বোরো মৌসুমে মানভেদে ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার টাকার বেশি।
টিবিএসের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারে ধান (কাঁচা) প্রতি বস্তা (১ মন) বিক্রি হচ্ছে ৭৯০- ৮০০ টাকা মন। তবে শুকনো ও চিকন ধান বিক্রি হচ্ছে ৯০০-১০০০ টাকার মধ্যে।
একই দামে বগুড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ধান বিক্রি হচ্ছে। নেত্রকোনার হাওড়ে কাঁচা ধান ৭০০-৭৫০ টাকা ও শুকনা ধান ৭৫০-৮২০ টাকা মন হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।
শেখপুরা ইউনিয়নের কুমোরপুর এলাকার কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, 'এবার যে ধান লাগিয়েছি, তাতে খরচ বেশি হয়েছে। সার, বিষের দাম বেশি, পানি সেচের খরচ বেড়েছে। এক বিঘা জমিতে (৪৪ শতাংশ হিসেবে) ধান আবাদে খরচ প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। যা গতবার ছিল ১৫-১৬ হাজার টাকা'।
তিনি বলেন, 'গতবার ধানের দাম সরকার দিয়েছে ২৬ টাকা, এবার ২৭ টাকা। কিন্তু সরকার এখনো সেভাবে ধান কেনা শুরু করে নাই। অন্যদিকে বাজারেও এর চেয়ে কম দামে ধান বেঁচতে হচ্ছে'।
একই এলাকার বর্গাচাষী মজিবর রহমান বলেন, 'সরকার ধান কেনা এখনো শুরু করেনি। ২৭ টাকা বা ১০৮০ টাকা মন হিসেবে ধান কিনলে কিছুটা লাভ থাকবে। তা না হলে বাড়তি খরচ সমন্বয় করা সম্ভব হবে না'।
বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আশ্রাফুজ্জামান বলেন, 'এবার বগুড়ায় ২৫ হাজার ১৮৬ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করা হবে। পুরোদমে ধান কেনা শুরু হলে স্থানীয় বাজারেও দাম আরো বাড়বে'।
দিনাজপুর সদর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাকিম হাসান বলেন, 'দিনাজপুরে একটু দেরী করেই ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়। কিছু জমিতে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। বর্তমানে কাঁচা ধানই বিক্রি হচ্ছে ১৫৮০ থেকে ১৬০০ টাকা বস্তা (২ মন)'। তবে আর কয়েকদিন পর বাজার আরও ভাল হবে বলে আশাবাদী তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'আমরা খাদ্য অধিদপ্তরকে অনুরোধ করেছি যাতে দ্রুত ধান কেনা শুরু করে। সরকার কেনা শুরু করলেই ধানের ভালো দাম থাকবে বাজারে'।
চলতি বোরো মৌসুমে সরকার কৃষকের কাছ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৬ লাখ টন ধান ও মিলারদের কাছ থেকে ৪০ ও ৩৯ টাকা কেজি দরে সাড়ে ১১ লাখ টন (আতপ ও সিদ্ধ) চাল সংগ্রহ করবে।
গত বোরো মৌসুমের চেয়ে প্রতি কেজি ধানে ১ টাকা ও চালে ৪ টাকা বেশি দিয়ে ধান চাল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়োছে সরকার। গত বছর ২৬ টাকা কেজি দরে ধান ও ৩৬ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল কেনে সরকার।
গত মাসের ২৮ তারিখ থেকে বোরো ধান এবং ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী আগস্টের ৩১ তারিখে সংগ্রহ কার্যক্রম শেষ করবে সরকার। যদিও এখনো পর্যন্ত কোন ধান, চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এবার শুরু থেকেই সরকারকে দ্রুত ধান ও চাল কিনতে হবে। না হলে গত বছরের মত ধান চাল সংগ্রহ কার্যক্রম হুমকিতে পড়বে। ক্রয় কার্যক্রম দেরিতে শুরু হলে কৃষকও ধানের দাম ঠিকভাবে পাবে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মজুদ পরিস্থিতির তথ্যমতে, গত ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের খাদ্য গুদামে ৫.১৪ লাখ মে. টন খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে, এর মধ্যে ২.৯৭ লাখ টন চাল ও ২.১৭ লাখ টন গম রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের ভাইস চ্যান্সেলর মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'সরকারের কেনাকাটায় দেরি হলে দুটি সমস্যায় পড়তে হবে। প্রথমত কৃষক ধানের প্রকৃত দাম পাবে না। দ্বিতীয়ত, সরকার তার প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের মজুদ গড়তে পারবে না। এজন্য সরকারের প্রকিউরমেন্ট দ্রুত শুরু করতে হবে। যেহেতু বিভিন্ন অঞ্চলে ধান কাটা প্রায় শেষ দিকে'।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারাদেশের হাওড়াঞ্চলের শতভাগ ধান কাটা হয়েছে। সারাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। এ বছর সারাদেশে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগীতা করেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের দিনাজপুর প্রতিনিধি বিপুল সরকার সানি ও বগুড়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম)