কোটি টাকার টিকিট বিক্রির স্টেশনে দুর্ভোগের শেষ নেই
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে বলা হয় পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল জোনের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনটি অন্যতম। সরকারের আয়ের দিক থেকেও চট্টগ্রামের পরেই এ স্টেশনের অবস্থান। প্রতি মাসে প্রায় এক কোটি টাকার টিকিট বিক্রি হয়ে থাকে এই স্টেশন থেকে।
প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে দুই হাজার যাত্রী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করে থাকেন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীদের সংখ্যা দিন-দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু যাত্রী সংখ্যার বিপরীতে বাড়েনি স্টেশনের সেবার মান। যে পরিমাণ আসনযুক্ত টিকিট ইস্যু করা হয় তা চাহিদা অনুযায়ী খুবই কম। এর মধ্যে বেশিরভাগ টিকিট-ই চলে যায় কালোবাজারিদের হাতে। ফলে যাত্রীদের বাধ্য হয়ে কালোবাজারিদের কাছ থেকে চড়া দামে টিকিট কিনতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-নোয়াখালী রেলপথে চলাচলকারী ৭টি আন্তঃনর, ৭টি মেইল ও কয়েকটি লোকাল ট্রেন দুইবার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রাবিরতি করে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাত্রীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৭০০ টিকিট। কিন্তু এই টিকিট সংখ্যা যাত্রীদের চাহিদার অর্ধেকের চেয়েও কম। বর্তমানে স্টেশনে আসনবিহীন টিকিট বিক্রির হারও বেড়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে প্রায় এক কোটি টাকার টিকিট বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন স্টেশন কর্তৃপক্ষ।
স্টেশনের কাউন্টার ও ‘রেলসেবা’ অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রার দিনের ১০দিন আগে থেকে টিকিট দেয়া হয় যাত্রীদের। তবে টিকিট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অধিকাংশ টিকিট কালোবাজারিরা কেটে ফেলেন। মূলত কাউন্টারে অতিরিক্ত টাকা দিয়েই টিকিট পান কালোবাজারিরা। এর ফলে ৭-৮দিন আগে কাউন্টারে গিয়েও টিকিট না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী।
স্টেশনের কালোবাজারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেনের প্রতিটি টিকিট ১৪৫ টাকার পরিবর্তে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট ২৩০ টাকার পরিবর্তে বিক্রি হয় সাড়ে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকায় এবং সিলেটগামী ট্রেনের টিকিট ২১০ টাকার পরিবর্তে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে উৎসব-পার্বনে টিকিটের দাম আরও বেড়ে যায়।
শরীফুল ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, ‘‘মহানগর এক্সপ্রেসে’ করে ঢাকা যাওয়ার জন্য টিকিট কিনতে ৫দিন আগে কাউন্টারে গিয়েছিলাম, কিন্তু টিকিট পাইনি। রেলসেবা অ্যাপেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। পরে এক কালোবাজারির কাছ থেকে ২৫০ টাকায় একটি টিকিট কিনেছি। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা চলছে স্টেশনে। স্টেশনের লোকজন জড়িত থাকার কারণেই কালোবাজারি বন্ধ হচ্ছে না।’’
যাত্রীদের অভিযোগ, স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত মাস্টার, টিকিট বুকিং ক্লার্ক এবং রেলওয়ে পুলিশের যোগসাজসে কালোবাজারিদের হাতে পৌঁছে যায় যাত্রীদের জন্য বরাদ্দকৃত টিকিট।
টিকিটি কালোবাজারি ছাড়াও যাত্রীদের আরও দুর্ভোগ পোহাতে হয় স্টেশনে। বিশাল সংখ্যক যাত্রীদের জন্য আন্তঃনগর ট্রেনের দুইটি এবং মেইল ও লোকাল ট্রেনের জন্য দুইটি টিকিট কাউন্টার রয়েছে। যাত্রীদের তুলনায় কাউন্টার সংখ্যা কম হওয়ায় টিকিটের জন্য দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এছাড়া ট্রেন ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে যাত্রীদের জন্য আসনবিহীন টিকিট সরবরাহ করার ফলে ট্রেন স্টেশনে ঢোকার আগমুহূর্তে কাউন্টারে যাত্রীদের ভীড় বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
আরিফ মিয়া নামে এক যাত্রী জানান, ‘‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে টিকিট পাওয়া মানে সোনার হরিণ হাতে পাওয়া। এমনিতেই টিকিট সংখ্যা কম, এরপর আবার কালোবাজারি সমস্যা। যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনা করে নতুন একটি ট্রেন দেয়া প্রয়োজন।’’
এদিকে, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যাত্রীদের জন্য থাকা স্টেশনের একমাত্র বিশ্রামাগারটির অবস্থাও দীর্ঘদিন ধরে নাজুক হয়ে আছে। শুধুমাত্র নামে প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগার হলেও এর ভেতরের নোংরা পরিবেশের কারণে বসতে পারেন না যাত্রীরা। মূলত বিশ্রামাগারটি স্টেশনের ভিক্ষুক আর ভবঘুরেদের দখলেই থাকে। এর ফলে যাত্রীদের স্টেশনের প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়েই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
হাফসা বেগম নামে আরেক যাত্রী বলেন, ‘‘মহানগর প্রভাতী ট্রেনে করে চট্টগ্রামে আত্মীয়ের বাসায় যাবো। ট্রেন আসতে দেরি হতে দেখে বিশ্রামাগারে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি বসার মতো পরিবেশ নেই। টয়লেটও তালাবদ্ধ। তাই বাধ্য হয়ে প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছি।’’
তবে কালোবাজারিদের সাথে যোগসাজসের অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই মোজাম্মেল খান বলেন,‘‘ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টিকিট কালোবাজারির সমস্যা অনেক আগের। টিকিট কালোবাজারি বন্ধ হোক আমিও চাই। চলতি মাসে আমি নিজে কালোবাজারি ধরে মামলা দিয়েছি। এমন কোনো মাস নেই যে দুই-তিনটা মামলা দিচ্ছি না, কালোবাজারি ধরছিনা। এখনও কয়েকজন জেলে আছে। এরা মূলত স্টেশনের বাইরে গিয়ে এই কাজ করে। টিকিট তো আর আমরা বিক্রি করি না, কাউন্টার থেকে তারা কীভাবে টিকিট পায় সেটা স্টেশন কর্তৃপক্ষই বলতে পারবে।’’
জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত মাস্টার মো. শোয়েব বলেন, ‘‘আমি ও আমার স্টেশনের কর্মচারীদের সঙ্গে টিকিট কালোবাজারিদের কোনো যোগসাজস নেই। কিছু মাদকাসক্ত যাত্রী বেশে কাউন্টার থেকে দুই-চারটি টিকিট নিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করে। কিন্তু যাত্রীরা চড়া দামে টিকিট না কিনলেই কালোবাজারি বন্ধ হয়ে যাবে। আর টিকিট সংখ্যা কম হওয়ায় টিকিট না পেয়ে অনেকেই কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ করেন।’’
তিনি আরও বলেন, এই স্টেশন থেকে প্রতি মাসে এক কোটি টাকার বেশি টিকিট বিক্রি হয়ে থাকে। নতুন একটি ট্রেন দিলে অথবা অন্য কোনো ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়া হলে যাত্রীদের আর কোনো অভিযোগ থাকবে না। আর যাত্রীদের তুলনায় টিকিট ও কাউন্টার স্বল্পতা এবং বিশ্রামাগার নিয়ে ইতোমধ্যে আমরা সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি পাঠিয়েছি। অচিরেই এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।