১৬% গ্রামীণ লোকজনের জন্য নেই কোন সড়কের সুবিধা
লাল মোহাম্মাদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিপচর উপজেলার চরপাকা ইউনিয়নের অধিবাসী। তিনি যে চরে বাস করেন তার দৈর্ঘ্য ৩২ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১০ কিলোমিটার। এ চরের জনসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ অথচ সেখানে কোনো পাকা রাস্তা নেই।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ চরের অধিবাসীদের মতো বাংলাদেশের ১৬% বা ২৬.৬৪ মিলিয়ন মানুষ বাড়ি থেকে বের হয়ে দুই কিলোমিটারের মধ্যেও কোনো রাস্তায় উঠতে পারে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬৬.৫ মিলিয়ন ধরে সড়ক অবকাঠামো থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সারা দেশের চরাঞ্চল, হাওড়. পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার মানুষ অর্থাৎ একটা বিশাল পরিসরে সাধারণ মানুষ গ্রামীণ সড়ক বা যে কোনো ধরনের সড়ক থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ছাড়া সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ছে এসব দরিদ্র মানুষ।
প্রতি অর্থবছর প্রাক-বাজেট আলোচনায় সংসদ সদস্যদের প্রধান চাহিদা থাকে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে। সে অনুযায়ী স্থানীয় সরকার বিভাগকে বরাদ্দও দেওয়া হয়। এ বরাদ্দ দিয়ে সারা দেশে গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের প্রকল্পও নেওয়া হয়। কিন্তু বঞ্চিত এলাকার মানুষের জন্য তেমন প্রকল্প নিতে দেখা যায় না।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের রুরাল এক্সেস ইনডেক্স (আরএআই) সুবিধা পাচ্ছে মোট জনসংখ্যার ৮৪% মানুষ। আরএআই হলো জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) একটি সূচক। এসডিজির এ সূচকের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে যে কোনো মানুষের বাড়ির অন্তত দুই কিলোমিটারের মধ্যে সড়ক নিশ্চিত করা।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়, ২০২৫ সালের মধ্যে আরএআই সূচকে ৮৪% থেকে ৯০% এ নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে আরও ৩৩০০০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারের এ পরিকল্পনায়।
কিন্তু এলজিইডিকে এ সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প নিতে দেখা যাচ্ছে না। যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ হয়ে থাকে। ফলে এখনই এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া না হলে এসডিজির আরএআই সূচকের লক্ষ্য অর্জন হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মোহাম্মদ ইউনুস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গ্রামীণ সড়ক থেকে বঞ্চিত হওয়া জনগণ এক ধরণের বন্দী জীবন যাপন করে । এসব এলাকার লোক সাধারণত দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। এসব মানুষকে যদি একটি সড়ক অবকাঠামো সুবিধা দেওয়া যায়, তবে দারিদ্র্য কমানো সহজ হবে'।
তিনি আরও বলেন, 'ইউনিয়ন ও উপজেলা সড়ক মাধ্যমে কোনো গ্রামকে সংযুক্ত করা গেলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংকিংসহ অনেকগুলো সেবা নিশ্চিত করে। সড়কের কারণে বাণিজ্য, বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয় । কৃষি প্রযুক্তির কারণে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ থাকে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা জোরদার করে। এতে কৃষক ও উদ্যোক্তা ন্যায্য মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারে'।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রতি অর্থবছরই স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাব অনুযায়ী গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় পরিকল্পনা কমিশন। সাম্প্রতিক সময়ে হাওর এলাকার সড়ক উন্নয়নে কিছু প্রকল্প নেওয়া হলেও পার্বত্য এলাকা বা চর এলাকার উন্নয়নে সড়ক প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর এসব মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব জনাব হেলালুদ্দীন আহমদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত কথা বলা যায়নি।
ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্সের সদস্য সচিব জাহিদ রহমান বলেন, 'দুর্গম চরের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ার কারণে পণ্য পরিবহনে খুবই অসুবিধা হয়। এতে করে চরের কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না। একইভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ার কারণে চরের মানুষের চিকিৎসা ঝুঁকিও বেশি। সুচিকিৎসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে চায় না। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হয় এসব মানুষ'।