বাঁশখালীতে সংঘাতের নেপথ্যে ‘শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-অব্যবস্থাপনা’: তদন্ত প্রতিবেদন
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষের পেছনে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঠিক সময়ে বেতন না দেওয়া, রমজানে ইফতার-সেহরীর সময় না দেওয়া ও শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসে বাধ্য করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের আলাদা দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্প গ্রুপ এস আলমের মালিকানায় নির্মাণাধীন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করে, যাদের অনেকেই সঠিক সময়ে বেতন না। এমনকি মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত শ্রমিদের বেতন না পাওয়ার প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। এছাড়া রমজান মাসে রোজা পালনকারী শ্রমিকদের ইফতার-সেহরী ও নামাজের সময় দেওয়া হতো না। শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থা ছিল অব্যবস্থাপনায় ভরা।
১৭ এপ্রিল শিল্প গ্রুপ এস আলমের মালিকানায় নির্মাণাধীন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। এতে ৭ শ্রমিক নিহত ও অন্তত ৩০ শ্রমিক গুরুতর আহত হন। ঘটনা তদন্তে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিষয়টি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।
ঘটনার দিনে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) জাকির হোসেন খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'বুধবার চট্টগ্রামের উপ-মহাপরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেনের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। এখন সে রিপোর্ট যাবে পুলিশ হেডকোয়াটার্সে। রিপোর্টে সংঘর্ষের জন্য বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এমন ঘটনা বন্ধ করতে নয়টি সুপারিশ করা হয়েছে'।
অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক জাকির হোসেন খান বলেন, 'শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১০ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করার দাবি, আমরা জেনেছি অনেক সময় বেতন পেতে শ্রমিকদের ১৮ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। এছাড়া তাদের থাকার যে ব্যবস্থা ছিলো তা নিয়েও তাদের আপত্তি ছিল। সেখানে টয়লেটের সমস্যা, পানি সাপ্লাই ও খাওয়ার পানির সমস্যা ছিল।'
চীনা শ্রমিকেরা বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করতো জানিয়ে জাকির হোসেন বলেন, 'শ্রমিকদের অন্যতম অভিযোগ হলো, কাজের সময় চাইনিজ যারা ওরা খারাপ ব্যবহার করে। রোজার শুরুতে নতুন অভিযোগ উঠে, শ্রমিকরা ইফতার করতে গেলে বা নামাজ করতে যেতে চাইলে চীনারা ছুটি দিতে চাইতো না। এ সময়গুলোতে বাংলাদেশি মুসলিম শ্রমিকরা অনুপস্থিত থাকলে চীনারা বাংলাদেশি শ্রমিকদের থেকে কর্মঘন্টা কেটে নিত।'
'এ ছাড়া চীনা ও বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা সংঘর্ষের জন্য দায়ী। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমন্বয়কারীদের ব্যবস্থাপনা ছিল খুব দুর্বল,' যোগ করেন জাকির হোসেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, 'বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনায় গঠিত পৃথক তদন্ত দুটি কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের রিপোর্টটি আমরা ক্যাবিনেটে পাঠিয়েছি। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে রিপোর্টের কাজ শেষ হয়েছে।' তবে জেলা প্রশাসক এসব তদন্ত প্রতিবেদনকে 'কনফিডেন্সিয়াল' উল্লেখ করে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবির আহম্মেদ বলেন, 'মূলত শ্রমিকদের কিছু দাবি দাওয়া ছিল, সেখান থেকেই পরিস্থিতির তৈরী হয়েছে। এর বেশি আমি বলতে পারছিনা।'
এ বিষয়ে জানতে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনা আক্তারের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ স্থান করা যায়নি।
সংঘাতের পেছনে স্থানীয় একটি মহলের ইন্ধন ছিল জানিয়ে অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক জাকির হোসেন খান বলেন, 'ঘটনার পেছনে রশিদ নামে এক স্থানীয় লোক আছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, সে বিভিন্নভাবে শ্রমিকদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ঘটনার দিন আন্দোলনের সময় রশিদ ভেতরে প্রবেশ করেছিল। এ সময় রশিদ অযাচিতভাবে শ্রমিকদের আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করছিল, সে শ্রমিকদের গায়ে হাতও তুলেছে। এরপরেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, সংঘর্ষে রূপ নেয়।'
অভিযুক্ত রশিদ কার পক্ষে কাজ করছিল জানতে চাইলে জাকির হোসেন খান বলেন, 'কেউ বলে শ্রমিকদের পক্ষে আবার কেউ বলে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের পক্ষে উস্কানি দিয়েছে রশিদ। তদন্তে আমরা বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানতে পারিনি।'
পুলিশ কেন গুলি চালিয়েছে জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, 'ঘটনাস্থলে পুলিশের সংখ্যা ছিল ১২ থেকে ১৩ জন। শুরুতে পুলিশ শ্রমিকদের বোঝাতে চেষ্টা করে। সংঘর্ষ শুরু হলে পুলিশ প্রথমে পিছিয়ে আসে। কিন্তু দেশি শ্রমিকরা যখন চীনা শ্রমিকদের হামলা করার চেষ্টা করে তখন পুলিশ শটগানের গুলি চালায়। এ সময় গুলি না করলে চীনাদের জীবনহানির আশঙ্কা ছিল। মামলার তদন্তে বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে।'
পুলিশের তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সময়মতো শ্রমিকদের মজুরি প্রদান, শ্রমিক কল্যাণ সভা করা, চীনা ও বাংলাদেশিদের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরীসহ ৯ টি সুপারিশ করেছে।