অতি করের আওতায় অতি ধনীরা
কর ব্যবস্থাপনায় ন্যায্যতা নিশ্চিতে দেশের অতি ধনী ব্যক্তিদের সম্পদের ওপর কর আদায় বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
আসন্ন বাজেট ঘোষণার পর, ব্যক্তিগত নিট সম্পদের মূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে ব্যক্তিভেদে সম্পদের ওপর ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ বা সম্পদ কর দিতে হবে। বর্তমানে, এই হার ৩০ শতাংশ।
এছাড়া, সরকার ন্যূনতম সারচার্জ প্রদানের পরিসীমাও বৃদ্ধি করতে চলেছে। ফলে, অপেক্ষাকৃত কম সম্পদশালীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে চলেছেন। নিট সম্পদের পরিমাণ তিন থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে ন্যূনতম ১০ শতাংশ সারচার্জ ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে, সারচার্জ মুক্ত নিট সম্পদের পরিমাণ আগের মতোই থাকছে। এবারও, সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি টাকা পর্যন্ত হলে কোনো সারচার্জ প্রদান করতে হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, নিট সম্পদের ওপর বর্তমানে দেশে সর্বোচ্চ সারচার্জের হার ৩০ শতাংশ। নিট সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি টাকার বেশি হলে ৩০ শতাংশ সারচার্জ বা সম্পদ কর প্রদান করতে হয়।
এছাড়া, একাধিক মোটর গাড়ি থাকলে বা সিটি করপোরেশন অঞ্চলে আট হাজার বর্গফুটের বেশি গৃহসম্পত্তি থাকলে করদাতাদের সেই সম্পদের উল্লেখ করাও বাধ্যতামূলক।
বর্তমানে, এই শ্রেণির করদাতাদের নিট সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি টাকার বেশি এবং পাঁচ কোটি টাকার কম হলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পদ কর প্রদান করতে হয়।
উন্নত কর ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ন্যূনতম সারচার্জ প্রদানের পরিসীমা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে ব্যখ্যা করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
নতুন ব্যবস্থাপনার ফলে সাধারণ মানুষ সম্পদ সম্পর্কিত তথ্য না লুকিয়ে তা প্রকাশে আগ্রহী হবে বলে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত হারে আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে সম্পদ কর প্রযোজ্য।
সারচার্জ বা সম্পদ কর এমন এক ধরনের মাশুল, যা ব্যক্তিগত সম্পদের দলিলমূল্যের ওপর নির্ধারিত হয়।
তবে, পুরো সারচার্জ ব্যবস্থার পুনঃসংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী নেতারা। পাশাপাশি, বিদ্যমান করদাতাদের স্বস্তি দিতে কর জাল বিস্তৃত করাও অত্যন্ত জরুরি বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে বর্তমান সারচার্জ ব্যবস্থার দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ডক্টর আহসান এইচ মনসুর।
"প্রথমত, রেজিস্ট্রেশন দলিলে উল্লেখিত ভূমিমূল্যের ওপর সারচার্জ আরোপিত হয়। ভূমির বর্তমান মূল্যের সাথে দলিলমূল্যের মিল থাকে না," বলেন তিনি।
বিষয়টি ব্যখ্যা করে তিনি আরও বলেন, "ধরুন, ১৯৬০ সালে কোনো ব্যক্তি স্বল্পমূল্যে গুলশানে এক বিঘা জমি কিনে ১০ তলার অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণ করেছেন। দলিলে উল্লেখিত মূল্যের ওপর সারচার্জ আরোপিত হলে এই ব্যক্তি করজালের বাইরে থেকে যাবেন।"
"অন্যদিকে, একই জায়গায় অপর ব্যক্তি তিন কোটি টাকা দিয়ে একটিমাত্র ফ্ল্যাট কিনলেও তাকে সারচার্জ প্রদান করতে হবে," বলেন তিনি।
সারচার্জ ব্যবস্থাপনার এই সীমাবদ্ধতা সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে বলে মন্তব্য করেন ডক্টর আহসান এইচ মনসুর।
বর্তমানে সারচার্জ আয়ের ওপর নির্ধারিত হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বিষয়টিকে তিনি অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সম্পদের বর্তমান মূল্যের ওপর সারচার্জ নির্ধারণ করা উচিত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সম্পদ মূল্য নির্ধারণ করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সম্পদ মূল্য নির্ধারণে ডক্টর মনসুর আয়কর বিভাগের অধীনে রাজস্ব বিভাগকে পৃথক দপ্তর চালু করার বিষয়টি বিবেচনার পরামর্শ দেন।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভলপমেন্টের (বিল্ড) সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ধনী ব্যক্তিদের উচ্চকর প্রদানের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী একটি সাধারণ চর্চা।
৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ সংযোজনের পাশাপাশি সারচার্জ প্রদানের নতুন স্তর গঠন মহামারিকালীন সময়ে কর আদায় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক এই সভাপতি আরও বলেন, "কর কর্মকর্তাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন কেউ কর ফাঁকি দিতে না পারে। ধীরে ধীরে, করযোগ্য আয়সম্পন্ন সকলকেই কর জালের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।"
ডক্টর মনসুরের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে তিনিও সম্পদের প্রকৃত মূল্যের ওপর সারচার্জ আরোপের বিষয়টি উল্লেখ করেন।
"কর জাল থেকে বাঁচতে বহু মানুষের মাঝেই সম্পদ লুকানোর প্রবণতা আছে," বলেন তিনি।
পাশাপাশি, অনেকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠান বা অন্যদের নামে ব্যক্তিগত সম্পদ, ঘর এবং গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করে থাকেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বিষয়টিকে তিনি অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন।
মহামারির পর যুক্তিসংগত সারচার্জ হার নির্ধারণ করার তাগিদ দেন এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক আবুল কাসেম খান। অন্যথায়, উচ্চ করদাতাদের ওপর বোঝার সৃষ্টি হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আবুল কাসেম খানের মতো ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমানও অতি ধনীদের ওপর সরকারের সারচার্জ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান।
"মহামারির সময় বেশি করে কর আদায়ের ক্ষেত্রে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদী বিবেচনায় বিষয়টি সংশোধনের প্রয়োজন হবে। তা না হলে, বৃহৎ করদাতাদের ওপর তা চাপ সৃষ্টি করবে," বলেন তিনি।
এছাড়া, তিনি সারচার্জ মুক্ত নিট সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি করে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত নির্ধারণের পরামর্শ রাখেন।
১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো সম্পদ কর চালু করা হয়। স্বাধীনতার পর সরকার এই কর আদায় ব্যবস্থা অব্যাহত রাখে।
১৯৮৬ সালে সরকার অর্থ আইনের মাধ্যমে সারচার্জ ব্যবস্থা স্থায়ী করতে আয়কর অধ্যাদেশে ১৬/এ ধারা যুক্ত করে।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপের মুখে ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা প্রত্যাহার করা হয়। তবে, ২০১১-১২ অর্থবছরে সরকার পুনরায় সারচার্জ আদায় চালু করে।