আমাদের সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ ও কনফুসিয়াসের নীতিশাস্ত্রে “জাঞ্জি’’ বা রাষ্ট্রের সেবকদের ভূমিকা
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর নামী প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে গোপন নথির ছবি তোলার অভিযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের কক্ষে গলা টিপে ধরা, পাঁচ ঘন্টা অফিস কক্ষে আটকে রাখার এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে যাবার পরও বিপুল সংখ্যক পুলিশ পাহারায় তাঁকে আদালতে নিয়ে যাওয়া এবং প্রথম দিন আদালতে জামিন নামঞ্জুর করে, পুলিশ ভ্যানে করে তাঁকে কাশিমপুরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সমগ্র দেশবাসীকেই মর্মাহত করেছে।
যাহোক, অবশেষে রোজিনা জামিন পেয়েছেন। তবে গোটা ঘটনায় বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের দূর্নীতি, সমাজের অন্য পেশার মানুষদের সাথে ভয়ানক উদ্ধত আচরণের ফুটে ওঠা ছবিটি- একদিকে যেমন পীড়াদায়ক, অন্যদিকে প্রায় ক্ষেত্রেই এসব সরকারি কর্মকর্তার ভেতরে প্রত্যাশিত শিক্ষাগত, পেশাগত ও সাংস্কৃতিক আচরণগত মান ও দক্ষতা খুঁজে পাওয়া যায় না। গত বছর লকডাউনের শুরুতে উত্তর বাংলার কোন এক শহরে এক পিতার বয়সী বৃদ্ধ দিনমজুরকে লকডাউনে ঘরের বাইরে বের হবার শাস্তি হিসেবে কান ধরে উঠ-বস করানো আরেক নারীও সরকারি কর্মকর্তা।
সরকারি কর্মকর্তাদের করা অন্যায়গুলোর ভেতর অন্যতম ভয়াবহ অপরাধটি সংগঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৫শে জুলাই। তিতাস ঘোষ নামে খুলনা শহরের ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া এক স্কুল বালক ২৪শে জুলাই একটি দূর্ঘটনায় আহত হলে তাকে খুলনা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় ২৫শে জুলাই খুলনা থেকে তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলা হলে, তার পরিবার অ্যাম্বুলেন্সে করে বাচ্চাটিকে নিয়ে ওই দিনই রাত আটটায় মাদারিপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে পৌঁছায়। কিন্তু নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব আব্দুস সবুর মন্ডল ফেরিঘাটে আসতে দেরি করায় আহত শিশুটিকে বহন করা অ্যাম্বুলেন্সটিকে তিন ঘন্টা ফেরিঘাটে আটকে রাখা হয়েছিল এবং মৃত্যুপথযাত্রী তিতাসের বাবা-মায়ের শত কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও ফেরি ছাড়া হয়নি। মাদারিপুর শহরের জেলা প্রশাসকের নির্দেশ মেনেই ভিআইপিদের জন্য এই দেরী করা হয় এবং তিতাসের বাবা-মা জরুরি নম্বর ৯৯৯, পুলিশ এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার ফোন করে অনুরোধ জানালেও ফেরি ছাড়া হয়নি।
রাতে পোনে এগারোটায় নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবসহ আরো কিছু ভিআইপি এলে এগারোটায় ফেরি ছাড়া হয়, এরপর রাত দেড়টায় ফেরি চলাকালীন অবস্থাতেই তিতাসের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী সবার শাস্তি হওয়া দূরের কথা, উল্টো এক বছর পুরো না হতেই যে সচিবের জন্য শিশুটির মৃত্যু হয়, সেই যুগ্ম-সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে তাকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক করা হয়। এমন বিবেকবর্জিত ও জবাবদিহিতাহীন, বিদেশি উপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার বর্বর ধারাবাহিকতা শুধু আমাদের মতো দেশগুলোতেই সম্ভব।
বাস্তবে, হাতেগোণা খুব ব্যতিক্রমী কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে বাদ দিলে, বিসিএস গাইড মুখস্থ করে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক যে সরকারি কর্মকর্তা আমরা পাচ্ছি, এদের ক'জন সৃজনশীলতা, মননশীলতা, মেধা ও সত্যিকারের দেশপ্রেমে দীক্ষিত- সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ে, চীনের সর্বকালের সেরা শিক্ষকদের অন্যতম কনফুসিয়াস কিভাবে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কর্মচারী তথা জনতার সেবকদের জন্য দেশ, জাতি ও সহ-নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য তথা নৈতিক আচরণের কতোটা উঁচু সীমাই না বেঁধে দিয়েছিলেন!
সত্যি বলতে পশ্চিমের দর্শণ এবং অনুশীলনের চেয়েও পূর্বের বিশেষত: পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতিতে আমলাতন্ত্রে গণতান্ত্রিক আত্ম-শাসনের বিষয়টি বরাবরই বেশি মান্যতা পেয়ে আসছে। পূর্ব এশিয়ায় আমলাতন্ত্রের এই নৈতিক যুক্তিগ্রাহ্যতা কনফুসিয়াস ও তাঁর শিষ্যদের শিক্ষার শেকড়ের রসে জারিত।
কনফুসিয়াস রাষ্ট্রের কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের জন্য নৈতিকতার যে মানদন্ড বেঁধে দিয়ে গেছিলেন, তার ভেতর রয়েছে মানুষের শাসন বনাম আইনের শাসন, ভাল সরকারি কর্মকর্তার চারিত্র্য লক্ষণ বা গুণাগুন, নৈতিক বিধিমালার প্রকৃতি এবং সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য শিক্ষা ও মেধার গুরুত্ব, রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারীদের সাথে কর্মকর্তারা কেমন আচরণ করবেন, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যের পারষ্পরিকতা এবং সমাজে শৃঙ্খলার প্রকৃতি।
আমলাতন্ত্রের নৈতিক ভিত্তি কেমন হওয়া উচিত, এবিষয়ক কনফুসীয় নীতি শিক্ষার আলোকে তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "ইউনিভার্সিটি অফ কানসাসে'-র শিক্ষক এইচ, জর্জ ফ্রেডেরিকসন তাঁর "কনফুসিয়াস অ্যান্ড দ্য মর্যাল বেসিস অফ ব্যুরোক্রেসি''-তে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নীতিগত মান বিষয়ে পশ্চিম ও পূর্বের ধারণার পার্থক্য তুলে ধরেছেন।
ফ্রেডেরিকসনের মতে, পশ্চিমে সাংবিধানিক, আইনী, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পেশাগত ভিত্তিসমূহের উপর আমলাতন্ত্র সুগঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু, আমলাতন্ত্রের নৈতিক মান সম্পর্কে পশ্চিমে ভাবনা কম। অন্যদিকে, পূর্ব এশিয়ায় জন-প্রশাসনের ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্নটিকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ওয়েবারও তাঁর "আমলাতন্ত্রের সমাজতত্ত্বে (ওয়েবার, ১৯৪৭)'' দেখিয়েছেন যে পশ্চিমে যেখানে জনপ্রশাসনের ভিত্তি হিসেবে নৈতিকতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় না, সেখানে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় (জাপান, চীন, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর এবং কোরিয়া) কনফুসিয়াসের শিক্ষার কারণেই গোটা জন-প্রশাসনের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে নীতিশাস্ত্রের ওপর।
আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিদ্যমানতা বলতে কি বোঝায়?
রোনাল্ড ইঙ্গলেহার্ট ও ম্যারিটা কার্বাল্লো নামে দুই গবেষক ১৯৯৭ সালে পৃথিবীর ৪৩টা দেশের মোট ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠী থেকে গৃহীত মতামত নমুনার ভিত্তিতে দৃঢ়তার সাথে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, পৃথিবীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির মানুষের মূল্যবোধে পার্থক্য বিপুল। গবেষকদ্বয় মতামত নমুনাগুলো গ্রহণ করেছিলেন ১৯৮১ ও ১৯৯০ সালের "বিশ্ব মূল্যবোধ সমীক্ষা'' থেকে।
এই গবেষণায় ইঙ্গলেহার্ট ও কার্বাল্লো লক্ষ্য করেন যে, ধর্মানুরাগী জনগোষ্ঠী অনেক সন্তানের পরিবার পছন্দ করে। আবার যত ধর্মানুরাগীই হোক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত বিকাশের সাথে সাথে পরিবার পিছু সন্তান সংখ্যা কমতে থাকে। এছাড়াও, তারা ল্যাটিন আমেরিকার ক্যাথলিক সমাজ থেকে পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত জনগোষ্ঠীসমূহের মাঝে ক. পরিবার, ঈশ্বর, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের মোড়কে ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্বের বীজ, খ. রাজনীতি, ব্যক্তিগত বিকাশ, দৃঢ়তা, অর্জন ইত্যাকার গুণাবলীর মোড়কে ধর্মনিরপেক্ষ-যৌক্তিক কর্তৃত্ব, গ. কাজ, টাকা, প্রযুক্তি প্রভৃতির উপর নির্ভর করে টিঁকে থাকার লড়াই এবং ঘ. বন্ধু-বান্ধব, অবসর, পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং সুখের মত বিষয়গুলোর ওপর মানুষের উত্তরাধুনিক ও উত্তর-বস্তুবাদী ভাবনার পরিসর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
মূলত: এই গবেষণা কাজ করতে গিয়েই ইঙ্গলেহার্ট এবং কার্বাল্লো লক্ষ্য করেন, পূর্ব এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপানে আমলাতন্ত্রের রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ঐতিহ্য। এ দুই গবেষকের ভাষায়, " গত প্রায় দুই হাজার বছর ধরে চীনের আছে তুলনামূলক ধর্মনিরপেক্ষ এক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এবং পশ্চিমে আমলাতন্ত্রের উদ্ভবের বহু আগেই চীনে কনফুসীয় মতবাদের আওতায় নৈতিক বলে বলীয়ান এক দক্ষ আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল। এবং আমলাতন্ত্রের এই নৈতিক ভিত্তির কারণেই এই সেদিন পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তেমন একটা বিকাশ ব্যতীতই চীন অন্য অনেক দেশের তুলনায় দ্রুত উন্নতি লাভে সক্ষম হয়েছে।
"রাষ্ট্রের প্রতি চীনের ঐতিহ্যবাহী জোর দেওয়াটাই পরের চার দশকের সমাজতান্ত্রিক শাসনের সময় আরো জোরদার হয়। জাপান, আর একটি কনফুসীয় মতাদর্শ প্রভাবিত রাষ্ট্রও খুব দ্রুত উন্নতি লাভ করতে সমর্থ হয়।" একই পর্যবেক্ষণ দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রেও সত্য। গবেষক ইঙ্গলেহার্ট আরো লক্ষ্য করেন, ১৯৬৫-১৯৮৪ সাল নাগাদ পৃথিবীর দশটি সবচেয়ে দ্রুতগতিতে অগ্রসর জাতি-রাষ্ট্রের ভেতর পাঁচটিই ছিল কনফুসীয় এবং বৌদ্ধ মতাদর্শ অবলম্বনকারী রাষ্ট্র।
এগুলো হচ্ছে: সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, তাইওয়ান এবং জাপান। চীনের অবস্থান ছিল দ্রুততম গতিতে অগ্রসর রাষ্ট্রগুলোর ভেতর ত্রয়োদশ। এছাড়া, এই সবচেয়ে দ্রুতগতিতে অগ্রসর বিশটি দেশের ভেতর আরো তিনটি দেশ রয়েছে যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চৈনিক সংখ্যালঘুরা বাস করে। সেই দেশগুলো হলো: মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়া। এছাড়াও, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পশ্চিম ইউরোপে পূর্ব এশিয়া থেকে আগত অভিবাসীরাও দ্রুতই বিপুল অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের সক্ষমতা প্রদর্শন করে। পূর্ব এশীয়দের এই দ্রুত সাফল্য লাভের বিষয়টিই গবেষক ইঙ্গলেহার্টকে তাদের আমলাতন্ত্রে কনফুসীয় মতাদর্শের দিকটি বিবেচনা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
কনফুসীয় রাষ্ট্রের মৌল রূপরেখা:
কনফুসীয় মতাদর্শ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের নেতা বা শাসকদের সেই দেশ বা রাষ্ট্রের শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার রক্ষার নৈতিক দায় থাকে, যাতে করে সবাই সুখী ও পূর্ণ জীবন-যাপন করতে পারে। এবং জনতাও নেতাদের সমর্থন করতে ততদিনই বাধ্য যতদিন নেতারা জনতার প্রতি সব কর্তব্য সঠিক ভাবে পালন করেন। যদিও কনফুসীয় মতাদর্শে সুনির্দিষ্টভাবে "চুক্তি"র কথা বলা হয়নি, তবু লক-রুশো-কান্ট এবং নতুন সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রণেতা জন রাউলসদের প্রণীত "সামাজিক চুক্তি'' অনুযায়ী রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং জনতার ভেতর বিদম্যান চুক্তির ভাবনা বহু আগেই কনফুসিয়াস উপস্থাপন করেছেন।
কনফুসীয় মতবাদে আইনের শাসন বনাম মানুষের শাসন:
পশ্চিমা রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা যখন আইন ও সংবিধানের উপর গুরুত্ব দেয়। জনপ্রশাসন বলতে আসলে আইনের সক্রিয়তাকেই বোঝায়। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশে সরকারি সংস্থা এবং সংগঠনগুলো আইন পরিষদকে সক্ষম করা এবং তার উপর ভিত্তি করে বার্ষিক আইনগত নানা বরাদ্দ রক্ষাকে গুরুত্ব দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও যেমন কেন্দ্রীয় সরকার ও ৫০টি প্রদেশের বিচারিক শাখা রয়েছে। বছর জুড়েই রয়েছে আইন পরিষদের নানা আইন প্রণয়ন ও সেই আইনগুলোর বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত নানা কর্মকান্ড। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গোটা স্প্যানিশ ভাষী দুনিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নেও আইন ব্যবসাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে উচ্চাকাঙ্খী ও আগ্রহীদের জন্য উপযুক্ত পেশা বলে মনে করা হয়। অথচ কনফুসিয়াস আইনকে একদম পছন্দ করতেন না এবং তিনি মনে করতেন, আইন মানুষকে ধূর্ত বানায়, আইনের ফলে সমাজে আইনানুযায়ী কাজ বাড়ে, তবে নীতি মেনে কাজ করাটা কমে যায়। যেহেতু আইন আমাদের সারাক্ষণই বলছে যে "কি কি করা অনুচিত" তবে প্রায় কখনোই বলে না- "আমাদের কি করা উচিত।" আইন সমাজে নৃশংসতা, সংঘর্ষ, বিবাদ ও মামলাও বাড়ায় বলে তিনি মনে করতেন।
কনফুসীয় মতাদর্শে এটাও বলা হয়েছে যে "যখন কোন সমাজে একের পর এক নতুন সব আইন প্রণীত হতে থাকে, বিভিন্ন নথি-পত্রের সংখ্যা বাড়তেই থাকে আর সেই সাথে অবিরত আইনের নানা সংশোধনীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন বুঝতে হবে যে সেই সমাজ তার মৌলিক মূল্যবোধ হারিয়েছে, হারিয়েছে সনাতনী ঐতিহ্য এবং সভ্যের চুক্তিগুলো। যে কোন সমাজের জন্যই বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়ন এবং ধারাবাহিক বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ তাদের নৈতিক অসুস্থতার স্বাক্ষরবাহী।''
যুক্তরাষ্ট্রের আর এক নামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পি.কে. হাওয়ার্ডের বিখ্যাত বই "দ্য ডেথ অফ কমন সেন্স: হাউ ল ইজ সাফোকেটিং অ্যামেরিকা" (১৯৯৫) বইটিতেও কনফুসীয় নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। হাওয়ার্ড তাঁর বইয়ে কনফুসীয় সময়ের একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যখা করেন- চীনে সেই সময় এক স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা প্রচুর মামলার নিষ্পত্তি করেছেন। কিন্তু, তাঁকে মোটেই প্রশংসা করা হয়নি। বরং ওই কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন অবস্থায় মানুষের ভেতর সংগঠিত অসংখ্য মামলা বা বিবাদ তাঁর অদক্ষতাকেই প্রমাণ করে।
যদিও ডেভিড আর রোসেনব্লুম, জন রোহর এবং ডেভিড কে. হার্টের মত মার্কিনী জন-প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মার্কিনী জন-প্রশাসনে সংবিধান ও আইনের গুরুত্বের কথা বলেছেন, হার্ট ও রোহর অবশ্য আমলাতন্ত্রের নৈতিক যোগ্যতার প্রশ্নও তুলেছেন। আজকাল কিন্তু অনেক জন-প্রশাসন বিশেষজ্ঞই রাষ্ট্রীয় শাসনে সুশীল সমাজের সম্পৃক্ততার প্রতি বেশি জোর দিচ্ছেন। এদের ভেতর রবার্ট পুটনাম, বেঞ্জামিন বার্বার, আমাতাই এটজিওনি এবং ডেভিড ম্যাথিউস আইন প্রণয়নের উপর গুরুত্ব হ্রাস করে সমাজের প্রতি ব্যষ্টিক ও সমষ্টিগত দায় বাড়ানো, নাগরিক কর্তব্য বাড়ানো, মধ্যস্থতা ও নাগরিক ঐক্যমত্য গঠনের উপর গুরুত্ব দেন- আর এই প্রতিটি উপাদানই কনফুসীয় মতাদর্শে বিরাজ করে (হার্ট, ১৯৮৪: রোহর, ১৯৮৪ ও রোসেনব্লুম: ১৯৮৩)। "আমি চাইলে মামলার নিষ্পত্তি করতে পারি, কিন্তু আমি চাইব যেন মামলা বিষয়টিই সমাজে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়,'' এটাই ছিল কনফুসিয়াসের মৌল বাক্য।
কেমন হবে একজন ভাল রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার চারিত্র্য?
খ্রিষ্ট জন্মেরও চারশো বছর আগে সামন্ত শাসিত চীনে কনফুসিয়াস শাসক ও শাসনের একটি সম্পূর্ণ নতুন সংজ্ঞা প্রণয়ন করেন। অভিজাতদের দ্বারা শাসিত সেই শাসন ব্যবস্থায় কনফুসিয়াস প্রথম "জাঞ্জি'' শব্দটি ব্যবহার করেন। "জাঞ্জি'' বলতে শুরুতে একজন বংশ পরম্পরায় শাসককে বোঝালেও ধীরে ধীরে শব্দটির রূপান্তর ঘটে এবং এর একটি নতুন, বিশুদ্ধ ও নৈতিক অর্থ দেখা দেয়।
কনফুসিয়াসই প্রথম জন্ম ও সম্পদসূত্রে আভিজাত্যের পুরোনো অর্থকে পাল্টে দিয়ে শাসকের জন্য গুণ, সংস্কৃতি, মেধা, সংস্কৃতি ও দক্ষতার অধিকারী হবার উপর জোর দেন (বারবার, ১৯৮৬ ও এটজিওনি, ১৯৯)।
সংক্ষেপে বললে, কনফুসিয়াসের যুক্তিতেই চীনে সামাজিক অভিজাতের বদলে নৈতিক অভিজাতের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনের ২,০০০ বছরের সাম্রাজ্যে এই পন্ডিত-শাসকদের শাসনই ছিল রাষ্ট্রের সার কথা। যদিও চৈনিক "জাঞ্জি'' শব্দটির ইংরেজি প্রতি-শব্দ হচ্ছে "জেন্টেলম্যান'' বা বাংলায় "ভদ্রলোক,'' তবে "জাঞ্জ'' শব্দটি ঠিক অন্য ভাষায় অনুবাদ করা কঠিন। একজন "জাঞ্জ'' হবেন শিক্ষিত, সাংস্কৃতিকভাবে পরিশীলিত ও পুরোপুরি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একজন সরকারি কর্মকর্তা। একজন ভাল সরকারি কর্মকর্তাকে সবার উপরে হতে হবে একজন নৈতিক ব্যক্তি। এবং এই নৈতিকতা কোন আইন ঘেঁটে পাওয়া সম্ভব নয়। সেটা শুধুই সেই আমলার ব্যক্তিগত নীতিবোধ থেকেই উদ্ভুত হওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র শিক্ষা ও নীতির জোরে বলীয়ানদেরই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পাওয়া উচিত বলে কনফুসিয়াস মনে করতেন, যিনি নৈতিক ক্ষমতার দৃষ্টান্ত স্থাপণ করবেন।
শাসকের নৈতিক ব্যর্থতায় মন্ত্রিপরিষদ ও জনগণের আস্থা হারিয়ে যায়। রাষ্ট্রের শেষ সম্পদ হলো দেশের শাসকের প্রতি জনতার আস্থা (লেইস, ১৯৯৭)।
কনফুসীয় প্রশাসককে সুশিক্ষিত, জ্ঞানান্বেষী, অর্থ-পদবি-তোষামোদে অবিচলিত, জনতার প্রতি সন্তান স্নেহসম্পন্ন, পিতা-মাতাকে সম্মানকারী এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হতে হবে। সততা, বিশ্বাস, করুণা, ক্ষমা, ন্যায়পরায়নতা, আনুগত্য, পরোপকার, মানুষের জন্য ভালবাসা থাকার পাশাপাশি দূর্নীতিগ্রস্থ শাসকের সাথে লড়াইয়ের সাহসও তার থাকতে হবে। সত্যি বলতে হালের নীতিশাস্ত্রগুলোও কনফুসিয়াসের নীতিশিক্ষার সাথে তূলনীয় নয়।
কনফুসীয় মতাদর্শে শিক্ষার উদ্দেশ্য:
কনফুসীয় মতাদর্শে নৈতিক চুক্তির গুরুত্ব রেনেসাঁর ফলে পশ্চিমা দর্শনে নৈতিকতার প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ হয়, সেই ভাবনারই আদি বীজ যেন।
যেমন, দার্শনিক মন্তেস্কুও সমাজে খুব বেশি আইনের কড়াকড়িকে নৈতিকতার পতনের সূচক হিসেবে দেখতেন। জন্মসূত্রে সামন্ত অভিজাতদের বদলে কনফুসিয়াস চেয়েছেন যেন মেধাবীরা দেশের প্রশাসন চালাতে পারে।
কেবলমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই কেউ একজন ভাল প্রশাসক তথা অভিজাত শাসক শ্রেণির অন্তর্গত হতে পারতেন। এভাবেই কনফুসিয়াস চীনে প্রথম শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভেতর যোগসূত্র স্থাপণ করেন। চীন, জাপান ও কোরিয়ায় সামাজিক গতিশীলতা অর্জনের বড় প্রণোদনা হিসেবে শিক্ষা দেখা দেওয়ায় অনভিজাত অভিভাবকেরাও সন্তানের শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক-অর্থনৈতিক মান্যতা আর্জনের প্রয়াস চালান। এবং সেই যুগেই কনফুসিয়াস শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে চেয়েছেন: "ধনী ও গরীব, অভিজাত ও অনভিজাত- সবার জন্য শিক্ষা হবে উন্মুক্ত। রাষ্ট্রের প্রশাসকদের মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা বা প্রশাসকদের জন্য পরীক্ষাও কনফুসিয়াসই বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম প্রবর্তন করেন। তবে, টাকা-কড়ি বা ক্ষমতার চেয়ে কনফুসীয় মতাদর্শে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নৈতিক ও মানবিক মানুষ গড়া। তাঁর প্রস্তাবিত শিক্ষা কার্যক্রমে সাহিত্য এবং বিশেষত: কবিতা, সঙ্গীত, ভাষা ও রাজনীতির উপর পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল। হালের পশ্চিমী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় "লিবারেল আর্টস কারিক্যুলাম'' নামে যে বিশেষ সিলেবাস আমরা দেখতে পাই, কনফুসিয়াস সেটাই প্রণয়ন করে গেছেন খ্রিষ্ট জন্মেরও আগে।
কনফুসিয়াস উদ্ভাবিত রীতি অনুযায়ীই আজকের দিনে পৃথিবীর নানা রাষ্ট্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রশাসকদের নিয়োগ দেয়া হয়। কনফুসীয় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল কারিগরী জ্ঞান নয়, বরঞ্চ মানবতার প্রচার ও প্রসার।
কীভাবে ক্ষমতাসীনদের সাথে আচরণ করতে হবে?
সরকারি কর্মকর্তাদের আজকের মত সেই প্রাচীন চীনেও মন্দ বা দূর্নীতিগ্রস্থ শাসকের সাথে বুঝে চলার বিষয় ছিল। কনফুসীয় শিক্ষাক্রমে তাই ভাল কর্মকর্তার অন্যতম যোগ্যতা ছিল সাহস: দরকারে খোদ রাজাকে কঠোর সত্য বলার সাহস।
কনফুসিয়াসের প্রধান শিষ্য মেনসিয়াস আমলাতান্ত্রিক সাহস বলতে সত্যের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাকে দরকারে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করাকে সাহস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এর সাথে আর পশ্চিমের সন্ত এ্যাকুনিয়াসের উদ্ভাবিত "সাহসে''র কথাই বলা যেতে পারে। শ্যুন জি নামে কনফুসিয়াসের আর এক শিষ্য বলেছিলেন, "ভাল কর্মকর্তা শাসককে নয়, প্রকৃত পথকে অনুসরণ করবে।''
বিশ শতকের পশ্চিমে হলোকাস্ট বা ইহুদি নিধনযজ্ঞের প্রেক্ষিতে প্রথম আমলাতান্ত্রিক সাহসের প্রশ্নটি দেখা দেয়। জার্মান আমলা ও নাজি অধিকৃত দেশগুলোতে সেসব দেশের আমলাদের ভেতর শ্রম বিভাজন, ক্ষমতার বিশেষায়ন এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন ও তীব্র ইহুদি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যথেষ্ট সাহসের অভাব দেখা দিয়েছিল, যদিও কিছু সততা সম্পন্ন জার্মান আমলা প্রতিবাদও করেছিলেন (এ্যারেন্টডট, ১৯৬৩)।
দূর্ভাগ্যজনক ভাবে পৃথিবীর প্রতিটি মতাদর্শই মানুষের কল্যাণের জন্য উদ্ভুত হলেও কালের প্রবাহে একসময় যেমন সেসব মতাদর্শ অবক্ষয়িত হয়, কনফুসিয়াসের মতাদর্শেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। মহান এই শিক্ষকের নীতিশিক্ষা শুরুতে ম্যান্ডারিয়ান সম্রাট, কৃষক, তরুণ ও ক্রীতদাসদের অনেক উপকারে আসলেও পরবর্তী দুই সহস্রাব্দে এর কিছু বিকৃতিও দেখা দেয়।
একটা পর্যায়ে এই নীতিশিক্ষাকে শাসকগোষ্ঠি যেন সাধারণ মানুষকে নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করতে থাকেন। তবে আজকের পূর্ব এশিয়ায় আবার প্রাচীন কনফুসীয় নীতিশিক্ষার ভাল ও উপযোগী দিকগুলোকে যুগের প্রয়োজনের সাথে তাল মিলিয়ে নবায়িত করা হচ্ছে।
শেষ কথা:
ইতিহাসের পাতা থেকে অজস্র দৃষ্টান্ত টেনে এনে আলোচনা হয়ত ফুরোবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও রাজধানীর নাম মুখস্থ করে রাষ্ট্রের প্রশাসক হওয়া আমাদের দেশের বিসিএস ক্যাডাররা কবে হবেন শিক্ষা-দীক্ষা-রুচি-সংস্কৃতি বোধ ও সর্বোপরি মানবিকতার আলোয় আলোকিত, সেটাই আজকের মৌল প্রশ্ন।
- লেখক: কবি, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক
- তথ্যসূত্র: Role of Bureaucrats in Confucius's teachings (H. GEORGE FREDERICKSON).