ভারতের কেন চীনা ভ্যাকসিন কেনা উচিত?
ব্যর্থ হয়েছে ভারতের টিকাকরণ কৌশল। কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর কালে অস্বীকারের প্রবণতা সংক্রমণকে দেয় লাগামহীন মাত্রা। তার সঙ্গে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত টিকার ডোজ শত কোটি প্রাপ্তবয়স্ককের জন্য যথেষ্ট হবে, এমন ভ্রান্ত ধারণা পুরো জাতিকেই বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে। জনগণের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, টিকা পাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টাও।
এর মধ্যেই জনসন অ্যান্ড জনসন, ফাইজার ও মডার্না ইঙ্কের আবিষ্কৃত প্রতিষেধক সংগ্রহের চেষ্টা শুরু হলেও, উন্নত দেশের এসব কোম্পানির ক্রয়াদেশের তালিকা এরমধ্যেই পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ, ভারতের দেওয়া নতুন ক্রয় চাহিদা পূরণে তাদের সরবরাহ ধীরগতির হবে তা প্রায় নিশ্চিত।
কর্তৃপক্ষ একটু বাস্তববাদী হলে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কাছ থেকে টিকা সংগ্রহ করে এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তির উপায় করতে পারবে। তবে এটাও সত্য; চীনা প্রতিষেধকগুলো অত্যাধুনিক জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়নি বটে, এমনকি সেগুলো হয়তো হার্ড ইমিউনিটি বা গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা অর্জন সহজ করবে না।
ইতঃপূর্বে সিশেলস দ্বীপপুঞ্জ সিনোফার্মের তৈরি প্রতিষেধককে তাদের কোভিড-১৯ টিকাদানের মূল উৎস হিসেবে বেঁছে নেওয়ার পরও সেখানে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু, ভারতে আপাতত গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা পরের ভাবনা, কারণ এপর্যন্ত টিকা পেয়েছেন মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ, এই গতিতে জাতীয় অনাক্রম্যতা অর্জন এমনিতেই সম্ভব নয়। এই অবস্থায় নয়াদিল্লি যদি সংক্রমণের পরবর্তী ঢেউয়ে আবারও দৈনিক হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং হাসপাতালের শয্যা বা অক্সিজেন সঙ্কটের মতো মানবিক দুর্ভোগ এড়াতে চায় তাহলে অন্তত চীনমুখী হতেই পারে।
লক্ষ্যটি অর্জনে ভারতকে অবশ্যই চীনের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপে অংশ নিতে হবে। তবে একথা বলা সহজ হলেও, করাটা কঠিন।
বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড কৌশলকে সন্দেহের চোখে দেখা থেকে শুরু করে, সীমান্ত বিরোধের মতো একাধিক স্পর্শকাতর ইস্যুতে নয়াদিল্লি- বেইজিং সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। আবার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পাল্লাও ঝুঁকে আছে চীনের দিকে। কিন্তু, সস্তা কৌশলের মধ্যে নিমজ্জিত ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা দীর্ঘদিন ধরেই সেসব সমাধানের পথ পাচ্ছেন না। যেমন; গেল বছর হিমালয় পর্বতমালার সীমান্তে রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর চীন থেকে আমদানি কমানো ও নতুন বিনিয়োগ আসা নিয়ন্ত্রণ করে 'স্ব-নির্ভরতা' অর্জনকে এক অঘোষিত নীতিতে পরিণত করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ভারতের সর্বস্তরের রাজনীতিকদের জন্য তাই হঠাৎ করে সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেডের টিকাগুলোর পক্ষে ওকালতি করা সহজ হবে না। কিন্তু, এই মুহূর্তে লাখ লাখ ভারতীয়কে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচানো এবং স্থায়ীভাবে অর্থনৈতিক উন্মুক্তকরণের চাইতে বড় জাতীয় স্বার্থ কী হতে পারে?
মেসেঞ্জার আরএনএ ভিত্তিক প্রতিষেধকগুলো দ্রুত পাওয়া গেলে, সেগুলোর ওপর নির্ভর করাটাই শ্রেয়। জেনেটিক কোড সম্বলিত এসব প্রতিষেধক দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির সঙ্কেত পাঠায়। উপসর্গযুক্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশে আবিষ্কৃত এই টিকাগুলো ৯০ শতাংশ সফল। সে তুলনায় নিস্ক্রিয় করোনাভাইরাসের মাধ্যমে প্রস্তুত করা চীনা টিকাগুলোর কার্যকারিতার হার ৫০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ, পশ্চিমা টিকাগুলোই সবচেয়ে ভালো উপায়।
কিন্তু, এমআরএনএ ভ্যাকসিনের ক্রয়াদেশ দেওয়া এবং সেজন্য দরকারি অত্যন্ত কম তাপমাত্রার হিমচক্র স্থাপনের সময় ছিল গত বছর। এখন ভারতের অবকাঠামোগত ভাবে দুর্বল কিছু রাজ্যের অনুরোধ সরাসরি নাকচ করে দিচ্ছে ফাইজার ও মডার্না।
এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার যদি উৎপাদক সংস্থাগুলোকে রাজি করতেও সম্মত হয় বা ৪৫ বছরের নিচের বয়সসীমার নাগরিকদের টিকাকরণের দায় প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিলও করে, তৃতীয় ঢেউয়ের তীব্রতা রোধে সেসবের কোনোটাই খুব একটা কাজে দেবে না।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ দুইশ কোটি ডোজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে ভারত। এজন্য রাশিয়ার স্পুটনিক ফাইভ টিকাকে যুক্ত করাসহ, স্থানীয় দুটি বৃহৎ উৎপাদক সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং ভারত বায়োটেকের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ শুরু হয়েছে। তবে স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের শেষ ট্রায়ালের তথ্য এখনও প্রকাশিত হয়নি। কোভ্যাক্সিন তৈরিতেও চীনা টিকাগুলোর মতো নিস্ক্রিয় করোনাভাইরাস ব্যবহার করা হলেও, এর প্রমাণিত কার্যকারিতা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা।
এই অবস্থায় ঘাটতি পুরণে পরিকল্পনাবিদদের নথিতে অন্য কিছু বিকল্প উপায় যুক্ত হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবিক অর্থে বর্তমানের 'ছিটেফোঁটা'র মতো ডোজ পরিস্থিতির উন্নয়নে এসব উপায় সামান্যই উন্নতি আনতে পারবে। সরকারি হিসাবেই, দৈনিক ২০ লাখেরও কম ভারতীয় টিকা পাচ্ছেন, যা আবার এপ্রিলের চাইতে ৪০ শতাংশ কম। ওই সময় সরকারি ভান্ডারে ডোজের মজুদও এখনকার মতো স্বল্প ছিল না।
অথচ, জোড়াতালি দেওয়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সীমিত পরিসরের স্বাস্থ্য বিমা থাকা একটি উন্নয়নশীল দেশে সবার আগে যত দ্রুত সম্ভব অধিক সংখ্যক টিকাকরণ করা দরকার ছিল। তারপরও, অনেকেই সংক্রমিত হলেও হয়তো তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার হতো না। জনবহুল আরেকটি দেশ ইন্দোনেশিয়া এক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নেয় সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন দিয়ে টিকা কর্মসূচি শুরু করে। দেশটির কর্তৃপক্ষ এখন জানাচ্ছেন, টিকাটি স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও মৃত্যুর হার কমাতে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এই তথ্যে ভারতের আশ্বস্ত হওয়া উচিৎ।
ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়ার এটাই সময়। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সিনোভ্যাকের কাছে তাদের আবিষ্কৃত টিকা জরুরি অনুমোদন দেওয়ার আগে আরও তথ্য চেয়েছে বলে মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে, ইতোমধ্যেই হু'র স্বীকৃতিটি অর্জন করেছে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন। অনুমোদন পাওয়ায় তারা এখন জাতিসংঘের কোভ্যাক্স কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র দেশে টিকা সরবরাহ করতে পারবে। তাই বেশি দেরী করলে চালান প্রাপ্তিতেও পিছিয়ে থাকবে ভারত।
চীনা ভ্যাকসিন গ্রহণের খরচ নিয়ন্ত্রণসাধ্য। প্রথম দিকে টিকা কিনতে ডোজপ্রতি ইন্দোনেশিয়া ১৪ ডলার করে মূল্য দেয়, কিন্তু এখন এত মূল্য কার্যকর থাকার কথা নয়। কিন্তু, তাতেই বা কি আসে যায়? এই মুহূর্তে ডোজপ্রতি ৩০ ডলার মূল্য দিলেও ভারতের ভ্যাকসিন দরকার। তারপরও, ইন্দোনেশিয়ার হিসাব ধরে নিলে দেখা যায়, শত কোটি ভারতীয় প্রাপ্তবয়স্ককদের ২৫ শতাংশকে দুই ডোজ চীনা টিকা দিতে হলে ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে,অথচ এর চাইতেও বেশি অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুদিন আগে সরকারকে লভ্যাংশ হিসেবে প্রদান করেছে।
বেইজিং যদি টিকাকে তার নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার না করে; তাহলে নিশ্চিন্তে থাকার মতো মজুদ এবং আগেভাগে সরবরাহ পেতে এই বিনিয়োগ হবে অত্যন্ত লাভজনক। তবে মাঝপথে এসে বেইজিং সেই সিদ্ধান্ত নিলে নয়াদিল্লি বেকায়দায় পড়বে।
তাই টিকা বাণিজ্যের সংলাপ নিয়ে উভয়পক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। ভারতের কিছু রাজ্য ও মহানগরের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি যে টেন্ডার দিয়েছেন সেখানে চীনের সঙ্গে স্থল সীমান্ত থাকা দেশগুলোর অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। এটি আসলে চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাককে সরিয়ে রাখারই ছদ্ম শর্ত। এসব কার্যকালাপ বেইজিংকে ক্ষুদ্ধ করেছে তা নিশ্চিত, যা প্রশমনের সময় এসেছে। তাছাড়া, ইতোমধ্যেই চীনের সঙ্গে যে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে- তা ভ্যাকসিন ক্রয়ের ফলে আরও বাড়বে এবং এসব কিছুই করতে হবে চীন বিরোধী জনগণের সামনেই, প্রকাশ্যে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে।
এই জটিলতা এড়াতে চাইলে মোদি এবার জনগণের প্রতি চীনে তৈরি মুঠোফোন বয়কটের আহবান জানাতে পারেন। এটি মনভোলানো চটক হলেও, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় জনগণ হয়তো সেই ত্যাগ স্বীকারের আইডিয়া পছন্দও করবে। কিন্তু, আসলেই কী তাই? এই ভারতীয়রাই প্রতিবছর চীনা স্মার্টফোন কিনতে বছরে ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করছেন। তাই মোদি যদি তাদের বোঝান, পাঁচ বছর স্মার্টফোন কেনা বন্ধ রেখে, তার সমান পরিমাণ অর্থ ১৫ বিলিয়ন ডলারে মাত্র একবার চীন থেকে ভ্যাকসিন কিনলে, ভারত স্মার্টফোনেও আত্মনির্ভর হতে পারবে, স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ঘটবে, বাড়বে কর্মসংস্থান- তাহলে যুক্তিটি নেহাত মন্দ দাঁড়ায় না। তাছাড়া, স্থানীয় চাহিদার চাপ কমলে তখন ভারতীয় টিকা উৎপাদকেরা জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিনের দরকার যেসব দেশে- সেখানেও রপ্তানির সুযোগ ফিরে পাবেন। তাহলে, পুরো বিশ্ববাসী যেমন অনেক বড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে, তেমনি ভারতও পাবে কিছুটা গৌরব নেওয়ার সুযোগ।
- লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট অ্যান্ডি মুখার্জি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবাখাত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। ইতোপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও কলাম লিখতেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত