ভিঞ্চির ‘সালভ্যাটর মুন্ডি’ নিয়ে দীর্ঘ তিক্ত-বিবাদ, উন্মোচিত হচ্ছে শিল্পকলার অন্ধকার দিক
রুশ ধনাঢ্য এক ব্যক্তি এবং একজন সুইস আর্ট ডিলারের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে যে কোটি কোটি টাকার মামলার লড়াই চলছে, তার চেয়ে বড় কোন বিবাদ হয়তো শিল্পকলার জগতে এর আগে দেখা যায়নি। রুশ ব্যক্তিটি দাবি করছেন, হাজার হাজার মিলিয়ন ডলারের শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি প্রতারিত হয়েছেন, অন্যদিকে সুইস আর্ট ডিলারের দাবি, এটা ছিল স্রেফ একটা ব্যবসা।
ছয় বছর ধরে বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা চলার পর আবারও বাজির দান উল্টে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই মামলা এতটাই আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এখন এটিকে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যরূপে গণ্য করা যায় এবং এর নাম দেয়া হয়েছে 'দ্য বুভিয়্যে অ্যাফেয়ার।'
রুশ সার ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি দিমিত্রি রিবোলভলেভ গত কয়েক বছর ধরেই আদালতে দাবি করছেন যে, গত এক দশকের মধ্যে তিনি সুইস আর্ট ডিলার ও ফ্রিপোর্ট স্টোরেজ ম্যাগনেট ইভ বুভিয়্যের কাছ থেকে যে ৩৮ টি অত্যন্ত দামী শিল্পকর্ম কিনেছেন; সেখানে তিনি ১ বিলিয়ন ডলার প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
কিন্তু সিএনএনকে দেয়া সর্বশেষ সাক্ষাতকারে বুভিয়্যে জানিয়েছেন, তিনিও বিলিয়ন ডলারের পাল্টা ক্ষতিপূরণ মামলা ঠুকে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দিমিত্রির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী মামলা চালানোর ফলে তার ব্যবসায়িক ক্ষতি ও সম্মানহানি হচ্ছে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি অভিযোগ করেন।
মামলা চালাতে ইতিমধ্যেই আইনজীবীদের এক বিশাল বহর তৈরি হয়ে গেছে কারণ দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়া ও রাজনৈতিক চক্রান্ত করাসহ অন্য সব অভিযোগ এনেছে।
শুধু তাই নয়, কচ্ছপগতিতে চলতে থাকা এ মামলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্ববিখ্যাত, অমূল্য সম্পদরূপে বিবেচিত কিছু বিতর্কিত শিল্পকর্মও। এর মধ্যে আছে ২০১৩ সালে কিনে নেয়া লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির চিত্রকর্ম 'সালভ্যাটর মুন্ডি', যার অকৃত্রিমতা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে বিতর্ক চলছে। আরো বলা হচ্ছে যে বুভিয়্যে এই চিত্রকর্ম থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি লাভ করেছেন।
অনেকেরই ধারণা বর্তমানের 'সালভ্যাটর মুন্ডি' আসলে ভিঞ্চির মূল কাজের নকল, আবার অনেকে একে আসলও মনে করেন। ২০০৫ সালে প্রথম একদল ডিলার এটিকে ১০,০০০ ডলারে কিনে নেন। আট বছর বাদে যখন এটিকে উদ্ধার করা হয় এবং ভিঞ্চির আসল কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তখন বুভিয়্যে ৮০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এটিকে কিনে নেন। দ্রুতই তিনি ১২৭.৫ মিলিয়ন ডলারে এই চিত্রকর্ম তার তৎকালীন গ্রাহক দিমিত্রির কাছে বিক্রি করে দেন। আদালতের জমা দেয়া দলিলে তখন ১ শতাংশ কমিশন নেয়ার কথা উল্লেখিত। কিন্তু দিমিত্রি যখন ২০১৭ নিলামে রেকর্ড ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে চিত্রকর্মটি বিক্রি করতে যান, তখন এটির আরেক গোপন দাবিদার বেরিয়ে আসেন। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। যুবরাজ দাবি করেন, বুভিয়্যে তাকে ঠকিয়েছেন; যদিও বুভিয়্যে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দিমিত্রি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃত জানালেও তার পরিবারের একজন মুখপাত্র বলেন, 'এখন সবকিছুই আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে আদালতে প্রমাণিত হবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বুভিয়্যে একজন আর্ট ডিলার হিসেবে তার ক্লায়েন্টদের প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতে সাহায্য করার ভান করেছেন, যার অর্ধেক অর্থই তিনি নিজের পকেটে ভরেছেন।
কিন্তু বুভিয়্যের দাবি, তিনি একজন 'শিল্প উপদেষ্টা', কিন্তু মামলা ও অভিযোগে সর্বত্র তাকে 'শিল্প বিক্রেতা' উল্লেখ করা হয়েছে যা নিয়ে তার আপত্তি আছে।
তিনি বলেন, 'দিমিত্রি এখনো পর্যন্ত তাকে দোষী প্রমাণ করতে পারেনি কারণ আমাদের চুক্তি অনুসারে এসব অভিযোগের ভিত্তিই নেই।'
শিল্পকর্ম নিয়ে এই দীর্ঘমেয়াদি আইনি লড়াই বর্তমানে শিল্প জগতের নানা সমস্যার দিক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। শিল্পকে স্রেফ পণ্য মনে করা, টাকার বিনিময়ে হাতবদল, কদর না বোঝা ও ভুল ব্যক্তির হাতে শিল্পকর্ম যাওয়া, দায়িত্বহীনতা ইত্যাদি সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
অন্যদিকে এসব আলোচনার ঝড় বয়ে গেলেও, 'সালভ্যাটর মুন্ডি' বহুদিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে। এপ্রিলে একটি ফ্রেঞ্চ প্রামাণ্যচিত্রে 'সেভার ফর দ্য সেল'-এ এটিকে প্যারিস ও রিয়াদের মধ্যে কূটনৈতিক চাল বলে অভিহিত করার পর তা আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। সৌদি এই চিত্রকর্মকে ভিঞ্চির আসল কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বোঝার জন্য ল্যুভর মিউজিয়ামে মোনালিসার পাশে প্রদর্শন করতে জোর দিয়েছে।
সারা বিশ্বে ভিঞ্চির মাত্র ২০ টিরও কম প্রকৃত চিত্রকর্ম থাকায়, 'সালভ্যাটর মুন্ডি'র সত্যতা যাচাই মানেই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বিষয়।
আসল লিওনার্দো?
ভিঞ্চির চিত্রকর্ম থেকে যারা টাকা লাভ করছেন, তাদের মনেও এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
দিমিত্রির একজন প্রতিনিধি ও বুভিয়্যের মধ্যে ইমেইল চালাচালি থেকে বোঝা যায়, বুভিয়্যে ২০১৩ সালে তার ক্লায়েন্টকে বলেছিলেন, এটি একটি সুন্দর চিত্রকর্ম হলেও ভালো বিনিয়োগ নয়। চিত্রকর্মটি এমনভাবে পুনরুদ্ধার করা হয় যে তা আসলেই ভিঞ্চি নিজে সম্পন্ন করেছিলেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ভ্যাটিকান কিংবা অন্য কোনো বড় জাদুঘরও এটি নেয়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। .২০১৩ সালের ২২ মার্চ একটি মেইলে বুভিয়্যে লিখেন, 'এমন একটা চিত্রকর্ম যা অন্য কেউ কিনতে চায়নি, তা এত চড়া দামে কিনলে হাসির পাত্র হতে হবে এবং বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাবে। এই চিত্রের খুব কম অংশই ভিঞ্চির নিজের আঁকা বলে মনে হচ্ছে।'
কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক আন্তোনি ভিটকিন সিএনএনকে জানান, বুভিয়্যে শিল্পজগতে একজন বহিরাগত হিসেবে যাত্রা শুরু করেন এবং শিল্পকর্মের মান নিয়ে যারা সন্দেহ তোলেন, তিনি তাদের মধ্যে একজন; যদিও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই 'সাল্ভ্যাটর মুন্ডি' কে আসল বলে দাবি করেছেন।
ভিটকিন বলেন, 'এটা খুবই আশ্চর্য যে তিনি মনে করেন, শিল্প বিশেষজ্ঞরা পুনরায় আবিষ্কৃত চিত্রকর্ম সালভ্যাটর মুন্ডির সত্যতা যাচাইয়ে ভুল তথ্য দিয়ে নিজেদের সুনাম নষ্ট করবেন।'
এর আগে ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের জাতীয় গ্যালারিতে 'সাল্ভ্যাটর মুন্ডি' প্রদর্শন করার পর এটি স্পটলাইটে আসে এবং সে সময় বহু গণমাধ্যমে এর খবর প্রকাশিত হয়।
বুভিয়্যের তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা সম্পর্কে বলেন, 'একসময় আমি একজন উদ্যোক্তা ছিলাম যে অনেক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এই মামলার পর থেকে আমি আমার সব সময় শুধু আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেই ব্যয় করে যাচ্ছি।' তবে বুভিয়্যে স্বীকার করেছেন যে তিনি 'সালভ্যাটর মুন্ডি'র মাধ্যমে দুদিনে ৪০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন।
শিল্প জগতের অস্বচ্ছতা
২০১৯ সালে প্রকাশিত 'দ্য লাস্ট লিওনার্দো' বইয়ের রচয়িতা ও ফিল্মমেকার বেন লুইস দেখিয়েছেন বুভিয়্যে এবং দিমিত্রির মধ্যকার এই লড়াই কিভাবে শিল্প জগতের কুৎসিত দিককে উন্মোচন করেছে।
লন্ডনে সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে লুইস বলেন, 'গোপন, অস্বচ্ছ এবং 'বিচক্ষণ' শিল্পকলা লেনদেনের ক্ষেত্রে কি কি সমস্যা হতে তা 'দ্য বুভিয়্যে অ্যাফেয়ার' ই দেখিয়ে দিয়েছে। তথ্যের গোপনীয়তা, অসৎ উপায় অবলম্বন, মিথ্যা, দুর্নীতি-এসবের কোনো শেষ আছে কি?
শিল্প সংগ্রাহক ও বিশেষজ্ঞ কেনি শাখতার বলেন, 'শিল্পকলা জগতও স্বর্নগয়না, রিয়েল এস্টেট বা ব্যাংকিং খাতের মতই দুর্নীতিগ্রস্ত। বিষয়বস্তু যা ই হোক না কেন; যখন এটা অনেক টাকার মামলা, তখন দুর্নীতি ও খারাপ কাজ হবেই।'
বুভিয়্যে যে শুধুমাত্র শিল্পপতিদের হয়ে একজন বাহক হিসেবে কাজ করেন তা নয়, তিনি দামি শিল্পগুলোকে লুকিয়ে রাখার মাধ্যমে নিজের একটি ক্যারিয়ারও বানিয়ে ফেলেছেন। তিনি জেনেভায় মুক্তবন্দর ব্যাবস্থাপনার একজন বড় বিনিয়োগকারী, যেখানে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে এবং কম কর প্রদানের মাধ্যমে ওয়্যারহাউজে শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করা হয়। সিঙ্গাপুর এবং লুক্সেমবার্গেও নতুন মুক্ত বন্দর স্থাপনে সাহায্য করেছেন বুভিয়্যে।
এখনো নিখোঁজ?
আইনি লড়াইয়ের বাইরেও অন্য যে প্রশ্নটি সবার মুখে মুখে ঘুরছে তা হলো, ''সালভ্যাটর মুন্ডি' এখন কোথায়? আক্ষরিকভাবেই এই প্রশ্নটি এখন '৪৫০ মিলিয়ন ডলারের' প্রশ্ন।
চিত্রকর্মটি এখন যুবরাজ সালমানের ইয়টে, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বুভিয়্যে। কারণ তিনি মনে করেন, সমুদ্রের বাতাসে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ভিটকিন বলেছেন, 'কে জানে হয়তো একদিন আমরা এটিকে ল্যুভর আবুধাবিতেই দেখতে পাবো!'
অন্যদিকে লুইস মনে করেন, এটি সৌদি আরবেই আছে। নিজদের শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে ব্র্যান্ডিং এর জন্য হয়তোবা বছর শেষ হবার আগেই উন্মোচন করা হবে। তিনি বলেন, 'সবচেয়ে সুন্দর শিল্পকর্মের পেছনেই সবচেয়ে কুৎসিত গল্পগুলো লুকিয়ে থাকে। 'সালভ্যাটর' মানে হলো 'বিশ্বের ত্রাণকর্তা।' কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তা সৌদি আরবের ত্রাণকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসবের মধ্যেই দিমিত্রি রিবোলভলেভ এবং ইভ বুভিয়্যের মধ্যকার আইনি লড়াই চলছেই, যার উপর নির্ভর করছে কোটি কোটি টাকা ও সম্মানের লড়াইও।
- সূত্র- সিএনএন