রেকর্ড ছাড়িয়েছে রডের বাজার, ৬ মাসে দাম বৃদ্ধি টনে ২০ হাজার টাকা
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে এম এস রডের দাম। মাত্র ৬ মাস আগে ৫২ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া ৭৫ গ্রেডের এম এস রড এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৭২ হাজার টাকায়। সেই হিসেবে, পাইকারি বা মিল পর্যায়ে গত ৬ মাসে প্রতি টন রডের দাম ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ও বিলেটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যটির দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।
বিএসআর গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেনগুপ্ত বলেন, রডের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ আর্ন্তজাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ ও স্ক্র্যাপ জাহাজের বুকিং দর বৃদ্ধি। গত বছর ২০২০ সালে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ছিল ২৬৫-২৭০ ডলারে। চলতি সপ্তাহে স্ক্র্যাপের বুকিং দর ৫৫০-৫৮০ ডলার অর্থাৎ স্ক্র্যাপের প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আমরা সরকারের মেগা প্রজেক্ট এবং ক্রেতাদের সামর্থের কথা ভেবে পণ্যের দাম দ্বিগুণ করতে পারি নি। এখনো উৎপাদন খরচের সাথে সমন্বয় করে পণ্য বিক্রি করছি।
এমএস রডের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ইস্পাতের বাজারে বর্তমানে চার কোয়ালিটির এম এস রড রয়েছে। এরমধ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বা অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৭৫ গ্রেড, সেমি অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৬০ গ্রেড, সাধারণ গ্রেড বা ৪০ গ্রেড এবং কোন সিল বা গ্রেড ছাড়া রড যা বাজারে 'বাংলা রড' বলে পরিচিত।
গত দুই দিনে ইস্পাতের বাজারে অস্বাভাবিক বেড়েছে ৭৫ গ্রেডের (৫০০ ওয়াট) রডের দাম। গত দুই দিনে দুই দফায় প্রতি টনে ২ হাজার টাকা বেড়েছে সর্বোচ্চ গ্রেডের এই রডের দাম। গতকাল বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের রড বিক্রি হয়েছে ৭০-৭২ হাজার টাকা দামে। যা গত সপ্তাহে ৭০ হাজার টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। আর গেল বছরের (২০২০ সাল) নভেম্বরের শেষ দিকে প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের রডের দাম ছিল মাত্র ৫০-৫২ হাজার টাকার মধ্যে। সেই হিসেবে, গত ছয় মাসে প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের রডের দাম বেড়েছে ২০-২২ হাজার টাকা।
সোমবার বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের মধ্যে ৭৫ গ্রেডের বিএসআরএম ও কেএসআরএম ৭২ হাজার টাকা, একেএস ও জিপিএইচ ৭১ হাজার টাকা ও গোল্ডেন ইস্পাত ৭০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
গত সপ্তাহের শেষদিন অর্থাৎ বৃহষ্পতিবারে বাজারে বিএসআরএম ও কেএসআরএম ৭০ হাজার টাকা, একেএস ও জিপিএইচ ৬৯ হাজার টাকা ও গ্লোডেন ইস্পাত ৬৮ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
গত দুই দিনে আরো এক দফা বেড়েছে সেমি অটো, সাধারণ গ্রেড ও বাংলা রডের বাজারও। গত ছয় মাসের ব্যবধানে এসব রডের দামও টনপ্রতি ২০-২২ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে
এর মধ্যে সেমি অটো মিলের ৬০ গ্রেডের রডের দাম দুই দিনের ব্যবধানে প্রতিটন ৬২ হাজার থেকে বেড়ে ৬৪-৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে সেমি অটো এম এস রডের মধ্যে পেনিনসুলা, ইসলাম স্টিল, আল কারা স্টিল, এনবিআর স্টিল, বলাকা স্টিল এমএসআরএম (মানতি) ও আম্বিয়া ব্রান্ডের রড উল্লেখযোগ্য। ছয় মাস আগে সেমি অটো মিলের ৬০ গ্রেডের রডের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৪২-৪৪ হাজার টাকার মধ্যে।
একই সময়ে দুই হাজার টাকা বেড়ে বর্তমানে সাধারণ ৪০ গ্রেডের প্রতিটন এম এস রড বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৬৩ হাজার ৫০০ টাকায়। দুই দিন আগে বাজারে একই মানের রড ৬০-৬১ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। সাধারণ গ্রেডের মধ্যে জিরি সুবেদার স্টিল, আল ছফা স্টিল, খলিল স্টিল, ব্রাদার্স স্টিল, রাইজিং স্টিলের বিকিকিনি বেশি।
গত ছয় মাস আগে অর্থাৎ গেল নভেম্বর পর্যন্ত পাইকারিতে ৪০ গ্রেডের রডের দাম ছিল ৪০ হাজার টাকার নিচে।
গত এক সপ্তাহে বাংলা রডের দাম টনে দুই হাজার টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬০ হাজার ৫০০ টাকায়। গত ছয়মাস আগে এসব বাংলা রডের দাম ছিল মাত্র ৩৭-৩৮ হাজার টাকার মধ্যে। বাংলা রডের মধ্যে বাজারে মাস্টার স্টিল, গোল্ডেন আয়রন, গোল্ডেন স্টিল, এস এল স্টিল, ভাটিয়ারি স্টিল ও চম্পা স্টিলের বিকিকিনি বেশি।
ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার কারণে অন্যান্য খাতের মতো গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে স্থবিরতা শুরু হয় দেশের নির্মাণ খাতেও। করোনা ও বর্ষার কারণে টানা ৫-৬ মাস স্থবিরতা শেষে গেল নভেম্বর থেকে আবার চাঙ্গা হতে শুরু নির্মাণ খাত। এরপর দফায় দফায় বাড়তে থাকে নির্মাণ পণ্য এমএস রডের চাহিদা।
চাহিদার চেয়ে পর্যাপ্ত সরবরাহ ও মজুদ থাকায় পণ্যটির দাম স্থির ছিল এতদিন। কিন্তু নভেম্বর মাস থেকে পণ্যটির চাহিদা আরো বৃদ্ধি পায়। এই সুযোগে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বাড়তে শুরু করে এমএস রডের দাম।
চট্টগ্রামের পাইকারি রডের বাজার আসাদগঞ্জের মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজ'র স্বত্বাধিকারী এস এম আরিফুজ্জামান বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও গেল নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এমএস রডের দাম স্থির ছিল। কিন্তু চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নির্মাণ পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দেয় মিল মালিকরা।
এরপর থেকে দফায় দফায় বাড়তে শুরু করে পণ্যটির দাম। এতে গেল ছয় মাসের ব্যবধানে পাইকারি বা মিল পর্যায়ে পণ্যটির দাম টনপ্রতি ২০-২২ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে কারখানা মালিকরা জানান, দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে গত ছয় মাসে রড উৎপাদনের কাচামাল স্ক্র্যাপ ও বিলেটের দাম টনপ্রতি ১৫-১৮ হাজার পর্যন্ত টাকা বেড়েছে। উৎপাদন মূল্যের সাথে দামের সমন্বয় করতে রডের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
গোল্ডেন ইস্পাতের পরিচালক সরোয়ার আলম বলেন, দেশের ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল শতভাগ আমদানি নির্ভর। এরমধ্যে ৭৫ শতাংশ বিলেট সরাসরি আমদানি হয় এবং বাকি ২৫ শতাংশ জাহাজ ভাঙ্গা থেকে যোগান আসে। দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে রড উৎপাদনের কাচাঁমাল স্ক্র্যাপ ও কেমিক্যালের বাজার বেড়েছে। তিন মাস আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি-মার্চে আর্ন্তজাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের বুকিং দর ছিল মাত্র ৪৬০-৪৭০ ডলার। যা বর্তমান বুকিং চলছে ৫৪৫-৫৫০ ডলার। একইভাবে দেশীয় বাজারে নভেম্বরের শুরুতে স্ক্র্যাপের দাম ছিল টনপ্রতি ৩০-৩৫ হাজার টাকা। যা বর্তমানে ৫০-৫২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল বৃদ্ধির কারণে এম এস রডের দাম বেড়ে চলেছে।