‘ভ্যাকসিন বিতরণ করুন, নয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে জলবায়ু চুক্তি’
বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও ভ্যাকসিন সহজলভ্য না হলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নেওয়া উদ্যোগের যা অগ্রগতি হয়েছিল তা আবারও পিছিয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশগুলোর নিজ জনগোষ্ঠীকে দুইবারের বেশি পূর্ণ টিকাদানের মতো ভ্যাকসিন মজুদ করেছে।
শুক্রবার কর্নওয়েলে তিন দিনব্যাপী জি-৭ এর সম্মেলন শুরুর আগে, দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকাদান পরিকল্পনার ব্যর্থতার কারণে ধনী দেশগুলোর সঙ্গে জলবায়ু সংকট নিরসনে কাজ করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বেশ কয়জন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ফলে চাপের মুখে পড়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও। বিভিন্ন মহল থেকে ধনী দেশগুলোর ওপর ভ্যাকসিন বিতরণের চাপ বাড়ছে।
"আগামী বছরের মধ্যেই পুরো বিশ্বকে টিকাদানের আওতায় নিয়ে আসা হবে মেডিক্যাল ইতিহাসের অন্যতম বড় কীর্তি। আমি জি-৭ এর নেতাদের আহ্বান জানাচ্ছি, ভয়াবহ এই মহামারি দূরীকরণে আমাদের সাথে যোগ দিন, এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে দেব না আমরা," বলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
গত শনিবার যুক্তরাজ্যে ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ছাড়িয়ে যায়।
এবারের কোপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক কূটনীতির এ গুরূত্বপূর্ণ সময়ে জি-৭ সম্মেলনকেই কাজে লাগাতে চাইছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। নভেম্বরে গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ সম্মেলনে ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিদেরও অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। তবে ধনী দেশগুলোর ওপর ভ্যাকসিন মজুদের অভিযোগ আসায় বিষয়টি জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভারের সাবেক প্রধান নির্বাহী ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের চেয়্যার পল পলম্যান এব্যাপারে বলেন, যতো দিন যাচ্ছে, অন্যতম দুটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ বিপজ্জনকভাবে একই সুতোয় বাধা পড়ছে।
"ভ্যাকসিন সরবরাহের ব্যাপারে ন্যায্যতা নিশ্চিত না হলে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বৈশ্বিক সংহতি ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারবো না। ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিন সরবরাহ ও জলবায়ু সংকট তহবিলে ভূমিকা না রাখলে, কার্বন নির্গমন কমাতে আরও বড় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে আসবে না উন্নয়নশীল দেশগুলো," বলেন তিনি।
ভ্যাকসিন সংকটের বিষয়টি তুলে ধরতে পারলে কোপ-২৬ সম্মেলন সফল হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জলবায়ু রক্ষার গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে ভ্যাকসিনের বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এব্যাপারে একমত কমনওয়েলথের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ডও।
"অবশ্যই জলবায়ু রক্ষার কর্মসূচি ও ভ্যাকসিনের ন্যায্য সরবরাহ দুটি বিষয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক আছে। আমরা ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন সরবরাহে বিনিয়োগ করলে ও ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই কেবল কোভিড-১৯ নির্মূল করা সম্ভব হবে। প্রতিটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সক্ষম তা নিশ্চিত করতে পারলেই সামনের দিনগুলোতে অর্থবহ চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবো," বলেন কমনওয়েলথ মহাসচিব।
এদিকে, কিশোর জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গ জানিয়েছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো যথেষ্ট ভ্যাকসিন সরবরাহ না পেলে কোপ-২৬ সম্মেলন বর্জন করবেন তিনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি একই আহ্বান জানিয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা।
ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের যুক্তরাজ্যের পরিচালক ও লেবর পার্টির সাবেক পরিবেশ বিষয়ক পরামর্শক জস গারম্যান জানিয়েছেন, ভ্যাকসিনের ব্যাপারে নির্দিষ্ট চুক্তি না হলে, ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলনের মতো ভাগ্য বরণ করতে পারে এবারের সম্মেলনও।
"কোভিড-১৯ এর মোকাবিলা করতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হচ্ছে। অকস্মাৎ এই আর্থিক ও স্বাস্থ্য সংকটের কারণে প্রায় ১০০টি'র মতো দেশ এখনো কোপ-২৬ সম্মেলনের জলবায়ু পরিকল্পনা জমা দেয়নি,"
"ধনী দেশগুলো থেকে সহযোগিতা পাওয়ার সাপেক্ষে কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারে কিছু দেশ পদক্ষেপ নিচ্ছে। জি-৭ ভ্যাকসিনের ব্যাপারে পদক্ষেপ না নিলে, কোপ-২৬ সম্মেলনের সফলতা সংকটের মুখে পড়তে পারে," বলেন তিনি।
যুক্তরাজ্য সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এব্যাপারে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেন, "আমরা জানি উন্নয়নশীল দেশগুলো বিদ্যমান তিনটি অন্যায় ও অন্যায্য পরিস্থিতি নিয়ে জি-৭ এর পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছে। দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী নয় তারা, নিজেদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষার তহবিল নেই তাদের, কোভিড থেকে সুরক্ষার জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতেও হিমশিম খাচ্ছে তারা।"
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশন সেন্টারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো প্রায় ৫৩০ কোটি ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে। অথচ দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা ১০০ কোটির কিছু বেশি মাত্র।
একজনের ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ প্রয়োজন সে হিসাব করলেও, বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশগুলোর কাছে নিজ জনসংখ্যাকে দু'বার সম্পূর্ণ টিকাদানের আওতায় আনার পরও আরও অনেক ভ্যাকসিন বাকি থাকবে।
জনপ্রতি সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন মজুদ করেছে কানাডা। মাত্র ৩ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার দেশটি ভ্যাকসিনের ৩৮ কোটি ১০ লাখ ডোজ সংগ্রহ করেছে। এ পরিমাণ ভ্যাকসিন দিয়ে দেশটির সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের ১০টি ডোজ দেওয়া যাবে।
যুক্তরাজ্য যে পরিমাণ ভ্যাকসিন মজুদ করেছে তাতে দেশটি সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ৭ ডোজ ভ্যাকসিন দিতে পারবে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো জনপ্রতি ৬ ডোজ, যুক্তরাষ্ট্র ৩ ডোজ ও জাপান ২ ডোজ সংগ্রহ করেছে।
অন্যদিকে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলো সরাসরি চুক্তি বা কোভাক্সের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
এর আগে, জনসন অ্যান্ড জনসন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ধৃত ভ্যাকসিনগুলো দরিদ্র দেশগুলোতে বিতরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তবে এখনো এ ভ্যাকসিন বিতরণ প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান