ব্ল্যাক ফাঙ্গাস: উচ্চ সংক্রমণের জন্য ডায়াবেটিস দায়ী?
ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১২,০০০ এ পৌঁছেছে। রোগীদের বেশিরভাগই সদ্য কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিরা। অত্যন্ত বিরল এই রোগের আক্রমণের ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন, ভারতে এই রোগের হার বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো দেশের নাগরিকদের মধ্যে উচ্চ ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডায়াবেটিস ছাড়াও এই রোগের পেছনে আরো কোনো কারণ আছে কি? অন্যান্য দেশগুলোতেই বা কি অবস্থা?
কোন কোন দেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দেখা দিয়েছে?
কোভিড মহামারির পূর্বে অন্তত ৩৮ টি দেশে মিউকোরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস এর আক্রমণের কথা জানা গেছে। প্রতি দশ লাখে ১৪০ জন আক্রান্ত নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানই শীর্ষে রয়েছে বলে লীডিং ইন্টারন্যাশনাল ফাঙ্গাল এডুকেশন সূত্র জানায়।
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঙ্গাল ইনফেকশন বিশেষজ্ঞ ডা. ডেভিড ডেনিং বলেন, 'মহামারির আগে বিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায় এবং ভারতে প্রচুর ডায়াবেটিস রোগী আছে।'
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড থেকে সেরে ওঠা যেসব ব্যক্তির ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হয়েছে, তাদের ৯৪ শতাংশের ডায়াবেটিসের সমস্যাও ছিল। এর মধ্যে ভারতেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগী আছেন ৭১ শতাংশ।
অন্যান্য দেশেও কি ডায়াবেটিসের সঙ্গে রোগের সংযোগ দেখা গেছে?
মাথাপিছু ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, এমন দেশগুলোতে (ভারত বাদে) ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের আক্রমণের কথা জানা গেছে।
ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনগণের মধ্যেও উচ্চ ডায়াবেটিস হার বেশি এবং ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দ্বারা আক্রান্ত হলেও, এই দুটি দেশে ভারতের মতো অত্যাধিক সংক্রমণ হয়নি।
বাংলাদেশে পাওয়া দুজন রোগীর একজনের চিকিৎসা চলছে এবং অন্যজনের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস পরীক্ষার ফলাফল এখনো আসেনি। তবে ডাক্তাররা জানিয়েছেন, দুজন রোগীরই ডায়াবেটিস আছে।
গণমাধ্যম সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানেও সম্প্রতি ৫ জন মিউকোরমাইকোসিস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে এবং চারজন মারা গেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়জনের ডায়াবেটিস ছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়।
রাশিয়াও তাদের দেশে বিচ্ছিন্ন ভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগী আছে বলে জানালেও, রোগীর সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। আমেরিকার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কোভিড আক্রান্তের দিক থেকেও তারা শীর্ষে।
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এর তথ্যানুযায়ী, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস অত্যন্ত বিরল, কিন্তু আমেরিকায় মাত্র ৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান না।
ডায়াবেটিস কেন ঝুঁকিপূর্ণ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস পরীক্ষা না করাই এখানে সবচেয়ে বড় ইস্যু। আইডিএফ এর হিসাব অনুযায়ী, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মধ্যে ৫৭ শতাংশ রোগীই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করান না এবং তাদের বেশিরভাগই ভারতীয়।
কিরগিজস্তানের ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অফ মেডিসিন এর ডা. হরিপ্রসাথ প্রকাশ বলেন, 'বেশিরভাগ ভারতীয়ই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান না। দেখা যায়, অন্যান্য রোগ পরীক্ষা করতে গেলে তাদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।'
আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ফাঙ্গাল ইনফেকশন সহ অন্যান্য ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তবে আফ্রিকা অঞ্চলেও ৬০ শতাংশের মতো ডায়াবেটিস রোগী থাকলেও, সেখানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ মাত্র ৩ শতাংশ।
ডা. ডেনিং এর মতে, এর কারণ হতে পারে যে সেখানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের পরীক্ষা করানোই হচ্ছে না। এটা পরীক্ষা করানোও খুব সহজ কাজ নয়। টিস্যু স্যাম্পল সংগ্রহ করার জটিলতা ও পরীক্ষা করানোর সংবেদনশীলতার কারণে অনেক সময়ই এই রোগের পরীক্ষা করানো হয়না।
আর কী কী কারণে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হতে পারে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিডের কিছু চিকিৎসার জন্য নির্বিচারে স্টেরয়েড নেয়ার ফলেও মিউকোরমাইকোসিস বা অন্যান্য ফাঙ্গাল ইনফেকশন হতে পারে।
ডেক্সামেথাসোন ও মেথিলপ্রেডনিসোলন- এই দুটি স্টেরয়েড ভারতে সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত হয় কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে। শরীরের ইমিউন সিস্টেমের সাড়াদানের ফলে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, তা কমাতে এসব স্টেরয়েড ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু হাসপাতালগুলো এবং ডাক্তাররা রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিধায় সঠিক তত্ত্বাবধান ছাড়াই এসব স্টেরয়েড দেয়া হচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি নিজে নিজে ওষুধ গ্রহণের ব্যাপারে নাগরিকদের সতর্ক করেছে। কারণ ভুল পদক্ষেপের ফলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
২০০০ কোভিড রোগীকে নিয়ে করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক এক ট্রায়ালে দেখা গেছে যে, তীব্র সংক্রমণের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ডেক্সামেথাসোন নিলে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে। কিন্তু সামান্য ইনফেকশনের ক্ষেত্রে এটি ক্ষতিকর হতে পারে। এরই মধ্যে ভারতের কিছু রাজ্যে জনসাধারণের মধ্যে হোম আইসোলেশন কিটসহ ডেক্সামেথাসোন বিতরণের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু ডা. ডেনিং জানিয়ে দিয়েছেন, বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষায়ই প্রমাণ পাওয়া গেছে যে অধিক স্টেরয়েড নেয়া মোটেও ভালো কিছু নয়।'
সূত্র: বিবিসি