দেশে তথ্য নৈরাজ্যের আশঙ্কা রয়েছে: নাগরিক প্ল্যাটফর্ম
বাজেটে প্রদর্শিত সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রজেকশনে গুরুতর অসঙ্গতি থাকায় তথ্য নৈরাজ্যের আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়া, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রদর্শিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়া মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।
রোববার বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের মিলিত জোট এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের বাজেট বিশ্লেষণ বিষয়ক এক আলোচনায় এই বক্তব্য উপস্থাপন করেন সভার আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, কোভিড মহামারির সময় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়টি বোধগম্য নয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৪ ডলার। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৪৬২ ডলারে দাঁড়াবে।
'আগের বছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছর দুর্বল ছিল। তা সত্ত্বেও বাজেটের হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থবছর অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দাবী নিয়ে আমার সন্দেহ আছে,' বলেন ড. ভট্টাচার্য।
এছাড়া, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) নিয়ে তিনি বলেন, 'গত বছর জিডিপি থেকে সরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগ ৮ দশমিক ১ শতাংশ থেকে চলতি অর্থবছরে এই বিনিয়োগ ৮ দশমিক ২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করেছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু গত অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ, যা চলতি বছরের এপ্রিল নাগাদ মাত্র ৫০ শতাংশ। অর্থবছর শেষ হতে আর মাত্র দুই মাস বাকি থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।'
একইভাবে, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিমাণ গত বছর ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি বছর ২৪ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত বছর ৮ দশমিক ৬ শতাংশ থাকলেও চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই হার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রায় অসঙ্গতি
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দারিদ্র্য বিমোচনে বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় গুরুতর অসঙ্গতির সন্ধান পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ২৩ শতাংশে দাঁড়াবে বলে উল্লেখ করা হয়। আগের বছর এই হার ধরা হয়েছিল ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ১৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা উল্লেখ করেন।
দেবপ্রিয় প্রশ্ন তোলেন, 'কোভিড-১৯ সংকটকালে মন্ত্রণালয় কীভাবে মহামারি-পূর্ব সময়ে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও দ্রুতগতিতে দারিদ্র্যের হার কমাবে?'
'বাজেটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চরম দারিদ্র্যের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই হার ছিল ৮ দশমিক ৩ শতাংশ,' বলেন তিনি।
এছাড়া, বাজেটে কর্মসংস্থান হারানো, নতুন করে দরিদ্রের তালিকায় যুক্ত জনগোষ্ঠী এবং মহামারি চালিত অন্যান্য বাস্তবতার কথাও বিবেচনায় রাখা হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে চিরাচরিত বক্তব্য
প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কোনো উদ্ভাবনী পরিকল্পনা বা নতুনত্ব নেই বলে উল্লেখ করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্রথাগত প্রশিক্ষণ, ইন্টার্নশিপ এবং স্বনির্ভরতার মধ্যেই কর্মসংস্থান পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী তরুণ; আর শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি।
এছাড়া, তিনি কর্মসংস্থান নিয়ে প্রকাশিত তথ্যেও অসঙ্গতির দেখা পান। অর্থমন্ত্রী আইটি খাতে দশ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও তা কখন ও কোথায় সৃষ্টি হয়েছে এ সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি।
এছাড়া, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আগামী তিন বছরে গড়ে ৬ লাখ মানুষকে দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের জন্য পাঠানোর পরিকল্পনা থাকলেও বাজেটে আগামী অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ২১ লাখ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ড. ভট্টাচার্য।
কর ছাড় কি কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা মূল্য হ্রাসে কার্যকরী হবে?
কর ও ভ্যাটের ওপর প্রস্তাবিত কর ছাড় শিল্পোৎপাদন খাতকে সহায়তা করবে বলে উল্লেখ করেন ড. ভট্টাচার্য। পাশাপাশি, আমদানিকৃত ভতুর্কিযুক্ত দেশীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চাকরিপ্রার্থী ও কর্মচারীরা বেতন-ভাতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই উদ্যোগ থেকে উপকৃত হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু তা নির্ণয় করার কোনো পরিকল্পনা বাজেটে রাখা হয়নি।
'পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় সরকার উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে,' মন্তব্য করেন তিনি। পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ ২০১৬ সালে শ্রমশক্তি জরিপ চালিয়েছে। তাই দেশের বর্তমান কর্মসংস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে তথ্য নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তথ্যে গরমিল কেন?
তথ্য বৈষম্যের জন্য একাধিক সংস্থাকে দায়ী করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি চারটি পৃথক নথিপত্রে প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।
'বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গৃহীত উদ্যোগ ও সামর্থ্যের অভাব গুরুতর। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা মানুষের জীবনযাত্রায় কোভিড-১৯-এর প্রভাব সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণা পরিচালনা করেছে। কিন্তু বিবিএস কোনো গবেষণা করেনি,' বলেন তিনি।
এছাড়া, সকল সরকারি সংস্থা তাদের অর্জনের বিষয়টি তুলে ধরতেই বিভিন্ন তথ্য প্রদর্শন করলেও ক্ষেত্রবিশেষে সেটাও অসমাপ্ত থাকে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শিক্ষা বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা গণস্বাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাত সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
সিডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ভার্চুয়াল গণমাধ্যম ব্রিফিংয়ের সভাপতিত্ব করেন।
'এসিডিজি অর্জনে আমাদের বর্তমান অবস্থান কোথায় এবং আমরা কোথায় চলেছি তা নির্ধারণে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই,' বলেন সুলতানা কামাল।