স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেই ২১ জুন ইউপি নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অনড় ইসি
ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণের মধ্যেই এ মাসের ২১ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ৩৭১ ইউনিয়ন পরিষদ, ১১টি পৌরসভা ও আরো কয়েকটি উপ-নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অনড় নির্বাচন কমিশন।
তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের নির্বাচন নিয়ে কমিশনের করার কিছু নেই বলে জানিয়েছে কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, "ইসির সাংবিধানিক কথাবার্তা একেবারে বাজে। এটি প্রকৃতি সৃষ্ট সংকট, মনুষ্য তৈরি কোন সমস্যা নয়। তাই ইসি চাইলে নির্বাচন বন্ধ রাখতে পারে। সাংবিধানিকভাবে সেই ক্ষমতাও তাদের দেয়া হয়েছে।"
"সরকার পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, লকডাউন চলছে। তার মধ্যে নির্বাচন করা স্বেচ্ছাচারি সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। এটা মানুষের জীবন আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। অবশ্য নির্বাচন দ্রুত করার ব্যাপারে প্রার্থীদেরও চাপ থাকে।"
ইসির উচিত লকডাউন শেষ হওয়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া। আদতে তাদের কাছে নির্বাচন একটা বোঝা। তাই যেকোনো উপায়ে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বোঝা তারা ঘাড় থেকে নামাতে চায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশের শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট এবং সরকারের কোভিড-১৯ বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, "গত কয়েক দিন ধরে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। এখনই জেলাগুলোতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করলে সারাদেশে সংক্রমণ ছড়াবে। সুতরাং যে কোন জনসমাগম পরিহার করা উচিত। জেলা থেকে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোন যানবাহন বাইরে যাবেনা"।
আগের দুই ওয়েভে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে কোভিড রোগীর চাপ বেশি ছিল, এবার সারাদেশে সংক্রমণ ছড়ালে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে বলে সাবধান করেন তিনি।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এসব স্থানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বিদ্যমান করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতেও নির্বাচনের সার্বিক কার্যক্রম লকডাউনের বাইরে রাখার জন্য ৬ জুন কমিশনের পক্ষ থেকে একটি চিঠিও ইস্যু করা হয়।
ওই চিঠিতে এসব ইউনিয়নে নির্বাচনের পাশপাশি সংসদীয় সিলেট-৩, ঢাকা-১৪, কুমিল্লা-৫ শূন্য আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের তফসিল ঘোষণার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে ৩ জুন এক চিচিতে ১৯ জেলার ৬৪ উপজেলায় ১ম ধাপে স্থগিতকৃত ৩৭১ ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ৩৬৭ ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচনের নির্দেশনা দেয় কমিশন।
ওই একই চিঠিতে একই তারিখে (২১ জুন) সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান, কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান ও সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের ১১ নং সাধারন ওয়ার্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশনাও দেয় কমিশন।
এদিকে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য বলছে, নির্বাচন অনুষ্ঠিতব্য এই ১৯ জেলার অধিকাংশতেই বর্তমানে করোনা সংক্রমণের উচ্চ গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কয়েকটি জেলা সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়ায়, এসব জেলায় উচ্চ সংক্রমণ সম্পন্ন ভারতীয় ধরন আধিপত্য বিস্তার করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মঙ্গলবারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই জেলাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৬ শতাংশ সংক্রমণের হার দেখা গেছে পিরোজপুর জেলায়। এখানকার সাত উপজেলার ৩১ ইউনিয়নে ২১ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
এরপরেই আছে সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা জেলা। এ জেলায় বর্তমানে সংক্রমণের হার ৫৫ শতাংশ। উচ্চ সংক্রমণের মধ্যে থাকা এই জেলার তালা ও কলারোয়া উপজেলার ২১ ইউনিয়নে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে।
বাকী যে ১৭ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে, সেখানে মঙ্গলবার বাগেরহাটে ৩৮%, খুলনায় ৩১%, ঝালকাঠিতে ৩১%, সুনামগঞ্জে ২৯%, ভোলায় ২৭%, নোয়াখালীতে ২২%, রংপুরে ১৬%, বরিশালে ১৬%, নরসিংদীতে ১৬%, বগুড়ায় ১৪%, চট্টগ্রামে ১২%, গাজীপুরে ১১%, মাদারীপুরে ১১%, কক্সবাজারে ৭%, লক্ষ্মীপুরে ৬% ও পটুয়াখালীতে ৩% হারে সংক্রমণ রেকর্ড কেরা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, "আলাদাভাবে নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে যেসব জায়গায় আক্রান্তের হার বেশি সেসব জায়গায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব আমরা আগেই দিয়েছি।"
সেই সাথে সেখানকার মানুষ সামাজিক দূরত্বসহ অন্যান্য সকল স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলবে- এমনটাই হওয়া উচিত। এই মুহূর্তে আমাদের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য কমিটির নিয়ম মেনে চলা জরুরী বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, "করোনা পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং নিঃসন্দেহে কিছু নির্বাচনী এলাকায় তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বৃহস্পতিবার কমিশন সভা রয়েছে, সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।"
"তবে লক্ষীপুর-৫ নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই। এটি করার জন্য সাংবিধানিকভাবেই বাধ্যবাধকতা রয়েছে।"
এদিকে করোনা পরিস্থিতি অবনতির মধ্যে ভোটের আয়োজন করায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কঠোর সমালোচনা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "নির্বাচন কমিশন জগদ্দল পাথরের মতো, কোনো কথা শোনে না। জনগণের চাহিদা, উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনা করে না। জনস্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম করেই যাচ্ছে"।