ধর্মতত্ত্বের কাছে রাষ্ট্রের নতি স্বীকার সামাজিক উন্নয়নের মূলে কুঠারাঘাত
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর 'গার্ড অব অনার' দেওয়ার ক্ষেত্রে 'নারী' ইউএনও বা 'নারী' ডিসি'র পরিবর্তে অন্য পদমর্যাদার 'পুরুষ' কাউকে দায়িত্ব দেওয়া। কোন মৃত ব্যাক্তির শেষ বিদায় অনুষ্ঠানে কোনো নারীর উপস্থিতি ধর্মীয় দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টির সাথে সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত রাষ্ট্র তুরস্কের ইসলামীকরণের সাথে এক ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এককালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম সাম্রাজ্য অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা দেশ তুরস্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান পৃথিবীর উপর কর্তৃত্ব হারিয়ে নিজ সীমানায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর কামাল আতাতুর্ক তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ধর্মীয় কারণে বিভক্তির বিপরীতে তুরস্কের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ধর্ম নিরপেক্ষতা তুরস্কের মানুষকে ইউরোপের সাথে সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। ইউরোপের সাথে তুরস্কের অটোমান সময়ের বিয়োগান্তক ঘটনাগুলো মানুষ ভুলে যেতে থাকে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ১৯৫৪ সালে তুরস্কের একটি ছোট্ট শহর কাশিমপাশায় জন্মগ্রহণ করেন। মাদরাসায় শিক্ষাজীবন শুরু। কোরানে হাফেজ রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান উচ্চশিক্ষার জন্য ইস্তাম্বুল আসেন এবং মারমারা ইউনিভার্সিটি থেকে 'অর্থশাস্ত্র এবং প্রশাসনিক বিজ্ঞানে' স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কিশোর বয়সে পিতার হাত ধরে যখন ইস্তাম্বুলে আসেন তখন দারিদ্র্যকে নিকট থেকে দেখেছেন। ইস্তাম্বুলের রাস্তায় এরদোয়ান লেবু ও তরমুজের শরবত বিক্রি করতেন বাড়তি আয়ের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেই এরদোয়ান রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে একেপি পার্টি (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভালপমেন্ট পার্টি) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই একেপি পার্টি জনসমর্থনে প্রথম স্থানে চলে আসে। তুরস্কের ইতিহাসে একক দল হিসেবে ২০০২, ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়। এরদোয়ান টানা ১২ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালে সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং দেশের শাসন ব্যবস্থা 'রাষ্ট্রপতি শাসিত' সরকারে রূপান্তরিত করেন।
এই দীর্ঘসময়ে দেশটি ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে ইসলামী ধর্মতত্ত্বের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকে। "নারীদের অধিকার পুরুষের সমান হওয়া উচিত নয়" বলে এরদোয়ান মন্তব্য করেন। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেন এবং 'জন্মনিয়ন্ত্রণ ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী' বলে ঘোষণা করেন। সম্প্রতি ইউরোপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত নারী অধিকার বিষয়ক সমঝোতা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। তুরস্কের আদালতের রায়ে আয়া সুফিয়ার পরিচয়ের পরিবর্তন ঘটে। ৯০০ বছরের অধিক গির্জা, সাড়ে ৪০০ বছরের মসজিদ এবং ৮৫ বছরের যাদুঘরের পরিবর্তে আয়া সুফিয়া আবার মসজিদে রূপান্তরিত হয়। ইউরোপ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। এরদোয়ান দেশটিকে ক্রমান্বয় একটি মুসলিম দেশে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন।
তুরস্ক লিবিয়া এবং সিরিয়ার যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। আজারবাইজানের যুদ্ধে পক্ষ অবলম্বন করে। ২০১৬ সালে এক অভ্যুত্থান চক্রান্ত সামাল দিতে ব্যাপক গ্রেফতার, চাকরীচ্যুতি, এমনকি গুপ্ত হত্যার অভিযোগ ওঠে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালের পর থেকে এরদোয়ানের রাজনৈতিক দল একেপি পার্টি আরো বেশি করে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব আঁকড়ে ধরে। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যের প্রশ্নে সেনাবাহিনীর সাথে বিরোধ এরদোয়ান 'মোকাবেলা' করেন। এই ধরনের পরিবর্তন এখন পৃথিবীর বহু দেশে লক্ষ্য করা যায়। দেশে যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না, সুশাসন থাকে না তখন শাসকগোষ্ঠী ধর্মতত্ত্ব আঁকড়ে ধরে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশ পিছিয়ে নেই।
আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি জামাতে ইসলাম ধর্মকে অবলম্বন করে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। অব্যাহতভাবে মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী অবস্থান পোক্ত করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবীদার সরকারের রোষানলে পড়ে তারা। সরকার জামাতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। সরকারের কৌশলগত অবস্থান, হেফাজতকে দিয়ে জামাতকে মোকাবেলা করা। ফলে খুব সহজে এবং অল্পসময়ে হেফাজতে ইসলাম মহীরুহে পরিণত হয়। হেফাজতকে কাছে টানার কৌশল হিসেবে কওমি শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ফলে লক্ষ লক্ষ নতুন তরুণ-তরুণী এই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়। কারণ এই শিক্ষাব্যবস্থা খুব সহজ এবং সাধারণ মানের। কেবলমাত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠই প্রধান পাঠ্য। সাধারণ শিক্ষার তুলনায় অনেক কম সময়ে সাধারণ শিক্ষার সমমানের স্বীকৃতি বা সনদ পাওয়া যায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি ধর্মনিরপেক্ষতা হয়ে থাকে তাহলে বর্তমানের নীতিগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সাংঘর্ষিক কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চরিত্রটিই পরিবর্তন করে দেন তখনকার স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ৷ তার শাসনামলে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ সংবিধানের ঐ অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়, ''প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে৷'' পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হলেও, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এখনো বহাল আছে৷ যদিও সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম থাকার পরও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বলা হয়েছে, সকল ধর্মের সমান অধিকার থাকবে। সবাই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে।
রাষ্ট্র কী সত্যিই পারে সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে? এটা আজ অনেক বড় প্রশ্ন। আমাদের পাশের দেশ ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যকে পদদলিত করে হিন্দুত্ববাদের চরম বিকাশ ঘটিয়েছে। ধর্মীয় তোষণনীতিকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নিতে পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের সময় আমরা দেখেছি। আমাদের মত দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় তোষণ একটি বহুল ব্যবহৃত রাজনৈতিক কৌশল। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত নীতি, চেতনা, ঐতিহ্য ধর্মতত্ত্বের কাছে পরাজিত হওয়ার প্রবণতা সমাজের জন্য ভয়ানক হতে পারে। এই ধর্মজীবীরা খুব কৌশলে ধাপে ধাপে এগুতে থাকে। তারা এখন প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সংবিধান ও প্রচলিত আইন চ্যালেঞ্জ করে ফতোয়া বোর্ড গঠন করে দেশ পরিচালনার কথা বলছে। এখন দেখার বিষয় রাষ্ট্র কিভাবে এটা প্রতিহত করে। সরকারের কৌশল এখনো স্পষ্ট নয়। ধর্মজীবদের তোষণ নীতি খুব যে কাজে আসেনি, তার প্রমাণ: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের সময় তাদের তাণ্ডব। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শেষকৃত্য বা দাফনে রাষ্টীয় প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে কোন নারী কর্মকর্তা থাকতে পারবেন না, এই প্রস্তাব যদি ধর্মতত্ত্বের ঝাণ্ডাধারীদের খুশি করার উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে, তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, এই কৌশল কাজে আসবে না।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রস্তাব, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধান পরিপন্থী বলে জানিয়েছেন, অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ। আমাদের সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।' ২৮ ধারা (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী- পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।' সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সুপারিশ উত্থাপনকারীগণ তাদের শপথ লংঘন করেছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার সময় অঙ্গীকার করেছেন, এই সংবিধানের 'সুরক্ষা' দিবেন। ইতিহাস আমাদের বিভিন্ন সময় জানিয়ে দিয়েছে, ধর্মকে আঁকড়ে ধরে শেষ রক্ষা হয় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছিলেন তারাও বলেছিলেন, ইসলাম রক্ষার জন্যই পাকিস্তানের অখণ্ডতা প্রয়োজন। এই ভণ্ডামি ধরতে এদেশের মানুষের খুব দেরি হয়নি। তুরস্কের আজকের প্রেসিডেন্ট ২০০২ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রথম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ব্যাপক সাফল্য নিয়ে আসেন। তুরস্কের অর্থনীতি একটি মজবুত ভিত্তি পায়। তুরস্কের মুদ্রা লিরার ডলারের বিপরীতে ১.৬ অবস্থান, কতটা শক্তিশালী তা সহজে অনুমান করা যায়। কিন্তু গত দুই দশকে তুরস্ক অর্থনীতির সেই শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে পারে নি। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি তাদের অর্থনীতিকে রুগ্ন করে তুলেছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থাও এই ধরনের। একটা দেউলিয়া অর্থনীতির দিকেই এগোচ্ছে তারা। ধর্মতত্ত্বের বিকাশ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে লালনের পরিণতি ভারত অচিরেই উপলদ্ধি করবে। ধর্মতত্ত্বের কারণে সামাজিক বিভক্তির ভয়াবহতা ভারতের জন্য অপেক্ষা করে আছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোর সমন্বিত অগ্রগমন ধরে রাখতে হলে সামাজিক বিভক্তির সকল উপাদান ঝেড়ে ফেলতে হবে। আমাদের দেশ এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে বিশ্বের নজর কেড়েছে। ইতিহাসের চাকাকে পিছনে নয় বরং সামনের দিকে নিতে হবে। ছেঁটে ফেলতে হবে সকল আগাছা।