যশোরে লাইসেন্সবিহীন চার হাজার চালকের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং
যশোরে চার হাজারেরও বেশি চালকের নেই কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স। তবুও তাদের হাতে রয়েছে পেশাদার গাড়ির স্টিয়ারিং। একই সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার বাস-ট্রাক অবৈধভাবে চলাচল করছে। ফিটনেটবিহীন এসব যানবাহন প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে ছুটছে সড়ক-মহাসড়কে। প্রতিদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। গত তিন বছরে যশোর-খুলনা, যশোর-বেনাপোল, যশোর-ঝিনাইদহ ও যশোর-নড়াইল আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কে ৫৪টি দুর্ঘনায় ৫৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গুরুতর আহত হয়ে দিন কাটাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
যশোরের উপর দিয়ে ১৮টি সড়ক ও মহাসড়কের যানবাহন চলাচল করে। ভৌগোলিক কারণে যশোর শহর গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পরিবহনের সংখ্যা অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি। এ জেলায় বৈধ গাড়ি ও চালকের পাশাপাশি অবৈধ গাড়ি ও চালকের সংখ্যাও বেশি।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলার বিভিন্ন সড়কে ভারী ও মাঝারি (বাস-মিনিবাস, ট্রাক-ট্রাক্টক-ট্রাংকলড়ি) যানবাহন চলে ১৩ হাজার ১৩১টি। এরমধ্যে চলাচলের বৈধতা রয়েছে ৮ হাজার ৩০৭টি গাড়ির। রুট পারমিট বিহীন বা অবৈধ চার হাজার ৮২৪টি গাড়ি। এসব গাড়ি জোড়াতালি দিয়ে মহাসড়কে নামানো হয়েছে। ১৩ হাজার ১৩১ জন চালকের মধ্যে ৮ হাজার ৮২৩ জন চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। চার হাজার ৩০৮ জন চালকের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। তারপরও তারা পেশাদার চালক হিসাবে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি হাকাচ্ছেন।
ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও অনুমোদনহীন চালকের কারণে সড়কে লাগামহীনভাবে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এতে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছেন। পঙ্গু হয়ে দিন কাটাচ্ছেন অগণিত মানুষ।
হাইওয়ে পুলিশের চারটি থানা ও ফাঁড়ি সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে যশোরের চারটি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৫৪টি দুর্ঘনায় ৫৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এরমধ্যে যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়কে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩৫ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়েছেন। যশোর-খুলনা জাতীয় মহাসড়কে জানুয়ারি ২০১৭ থেকে অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত ১৪টি দুর্ঘটনায় ১৮ জন প্রাণ হারান। যশোর-ঝিনাইদহ জাতীয় মহাসড়কের যশোর শহরের পালবাড়ি মোড় থেকে সাতমাইল হৈবতপুর পর্যন্ত জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত তিনটি দুর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছেন। এছাড়া যশোর-নড়াইল আঞ্চলিক মহাসড়কে একটি দুর্ঘটনায় একজন নিহত হন। এসব দুর্ঘটনায় যশোরের নাভারণ, নওয়াপাড়া, তুলারামপুর ও ঝিনাইদহের বারোবাজার হাইওয়ে থানায় ৫৩টি মামলা করা আছে।
বারোবাজার হাইওয়ে থানার পুলিশ পরিদর্শক শেখ মাহফুজার রহমান বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত গাড়ির চালকরা দায়ি থাকেন। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ও দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানোর কারণে মনোযোগ নষ্ট হয়। এতে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো দুর্ঘটনার আরো একটি বড় কারণ।’
বিআরটিএ যশোর সূত্রে জানা গেছে, যশোর থেকে বিভিন্ন রুটে তিন হাজার ২০২টি বাস-মিনিবাস চলাচল করে। এরমধ্যে ২৮০টি বাসের চলাচলের বৈধতা (রুট পারমিট) নেই।
যশোর জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আলী আকবর বলেন, ‘যেসব গাড়ির ফিটনেস নেই, সেইসব বাস মালিকদের বার বার নোটিশ করে রুট পারমিট নবায়ন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা করছেন না। এ বিষয়ে আমরা বাসের মালিকদের বলেছি, আইন মানতে হবে। প্রশাসন গাড়ি ধরলে আমাদের সমিতি থেকে কিছুই করার থাকবে না।’
তাহলে প্রশাসন ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরে জরিমানা করলে আপনারা ধর্মঘট ডাকেন কেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা তো ধর্মঘট ডাকি না। শ্রমিকেরা তাদের স্বার্থে ধর্মঘট করে।’
‘বাস্তবতা হলো ১০-১৫ বছর ধরে মালিকেরা গাড়ির ফিটনেস নবায়ন করেননি। জরিমানা হতে হতে এখন গাড়ির মূল্যের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। যে কারণে তারা ফিটনেস নিতে এখন আর আগ্রহী হচ্ছেন না। তারপরও দেখি আমরা কি করতে পারি।’
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, বাসের পাশাপাশি যশোরে ৯ হাজার ৯৫৮টি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-ট্যাংকলড়ি-টিপার (মাটিটানা গাড়ি) চলাচল করে। এরমধ্যে ৪ হাজার ৫৪৪টি গাড়ির চলাচলের বৈধতা নেই।
যশোর শহরের খাজুরা ট্রাক স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তার দুই পাশে পার্ক করে রাখা অধিকাংশ ট্রাকের কাঠামো তুলনামূলক লম্বা। কয়েকটি ট্রাকে কাঠামোর দুইপাশে অতিরিক্ত লোহার অ্যাংগেল লাগানো আছে। এসব ট্রাকের ইঞ্জিনের অবস্থাও খারাপ। স্ট্রার্ট দিলেই কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারপাশ।
যশোর জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও যশোর পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার বলেন, ‘ট্রাকের কাঠামো ১৫ ফুট লম্বা হওয়ার কথা। কোন ট্রাকের মালিক যদি ১৬ ফুট করেন-তাহলে তো ফিটনেট সনদ পাবেন না। এর জন্য কে দায়ি? এসব ট্রাকের দায় দায়িত্ব সমিতি নেবে না। আমরা ট্রাকের মালিকদের স্পষ্ট করে বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছি।’
বিআরটিএ যশোরের সহকারী পরিচালক কাজী মো. মুরসালিন বলেন, ‘রুট পারমিট (চলাচলের বৈধতা) পাওয়ার শর্ত হলো-গাড়ির ফিসনেট থাকতে হবে। আমরা দেখেছি, যাদের গাড়ির রুট পারমিট নেই ওই গাড়ির কাঠামো ও ইঞ্জিন নম্বর পরিবহন করা হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ বছর ধরে রুট পারমিট খেলাপী হওয়ায় তাদের জরিমানা বেড়ে গেছে। তারা জরিমানা মওকুফের আশায় বসে আছেন। অভিযান চালালেই গাড়ির মালিক ও শ্রমিকেরা অযৌক্তিভাবে ধর্মঘট শুরু করেন। জনগণের ভোগান্তির কথা ভেবে আমরাও তেমন কিছু করতে পারি না।’
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলায় ১১ হাজার ৩৫২টি ভারি ও ১ হাজার ৭৭৯ টি মাঝারি যানবাহনের নিবন্ধন রয়েছে। এর বিপরীতে ভারি যানবাহন চালানোর জন্যে ৭ হাজার ২১২ ও মাঝারি যানবাহন চালানোর জন্যে এক হাজার ৬১১ জনের ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। যা যানবহনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
এ বিষয়ে যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা হোসেন বলেন, ‘আমরা সবাই ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে চাই। কিন্তু লাইসেন্স পেতে অনেক জটিলতা রয়েছে। লাইসেন্সের জন্যে আবেদন করে পরীক্ষা দিয়ে কার্ড হাতে পেতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়। লাইসেন্স নবায়ন করতে কয়েক মাস ধরে বিআরটিএ অফিসের বারান্দায় ঘুরতে হয়। আমাদের শ্রমিক ভাইদের কি এতো সময় বা ধৈর্য আছে। এজন্য আমরা সরকারের কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তি সহজীকরণের দাবি জানিয়েছি।’
এ বিষয়ে বিআরটিএ যশোরের সহকারী পরিচালক কাজী মো. মুরসালিন বলেন, ‘প্লাস্টিকের স্মার্ট কার্ড বিদেশ থেকে আসে। এই কার্ড বাংলাদেশে সরবরাহ নেই। ছয়মাস ধরে এই কার্ড আমদানি বন্ধ রয়েছে। যে কারণে বিদেশে যাওয়ার মত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হচ্ছে না। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স হিসাবে চালকদের স্লিপ দেওয়া হচ্ছে। ওই স্লিপ মূল লাইসেন্সের কাজ করছে। প্রশাসন এরজন্যে তাদেরকে জরিমানা করবে না।’