৭৫ বছর আগে প্রথম মোবাইল ফোন কলটি করা হয়
উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতে আজকাল হাতঘড়িতেই দেখা মিলে সেলফোনের। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি মানুষ এখন আর তেমন গ্রাহ্য করে না। তবে, খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন এই বিষয়গুলো স্রেফ কল্পবিজ্ঞানের পাতায় পাওয়া যেত। কাল্পনিক বিষয় থেকে প্রযুক্তির বাস্তবে রূপান্তরিত হওয়ার যাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না। হাতঘড়িতে সেলফোন যুক্ত করতে যে পরিমাণ সময়, অর্থ, মেধা এবং প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়েছে তার পেছনে আছে যুগ-যুগান্তের ইতিহাস।
আজ থেকে ৭৫ বছর আগে প্রথম মোবাইল ফোন পরিষেবা প্রদর্শিত হয়। ১৯৪৬ সালের ১৭ জুন গাড়িতে ৮০ পাউন্ড ওজনের টেলিফোন স্থাপন করা হয়।
তবে, পরিষেবাটি কেবল মাত্র বড় বড় শহর এবং মহাসড়কেই দেখা মিলত। এছাড়া, ব্যক্তিগত ব্যবহারকারীদের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল।
গাড়ির ট্রাঙ্কের অধিকাংশ অংশ দখল করে রাখত ফোনের সরঞ্জামাদি। গ্রাহকরা হ্যান্ডসেট তুলে নিয়ে সুইচবোর্ড অপারেটরের সাথে কথা বলতেন। ১৯৪৮ সাল নাগাদ গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে পাঁচ হাজারে দাঁড়ায়।
প্রথম মোবাইল ফোন পরিষেবা পরিচিতির প্রায় তিন দশক পর প্রথম হাতে ধরা মোবাইল ফোনটি প্রদর্শিত হয় ১৯৭৩ সালে।
এই ঘটনারও প্রায় তিন দশক পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর হাতে মোবাইল ফোন আসে।
ছোট ফোনের বড় ইতিহাস
বর্তমান মোবাইল ফোন প্রযুক্তির পেছনে আছে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের অবদান। প্রতিটি যন্ত্রাংশ বিকাশেই প্রয়োজন হয়েছে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার।
তবে, সকল ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির বিবর্তনের একটি সাধারণ ধারা হলো মিনিয়েচারাইজেশন বা অপেক্ষাকৃত ছোট রূপ ধারণ। রেডিও ট্রান্সমিটার, প্রসেসর এবং ব্যাটারি সবগুলো প্রযুক্তিই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সফলভাবে হালকা ও ছোট রূপ ধারণ করেছে।
তবে, মুঠোফোন একা কিছুই করতে পারতো না, যদি এর পেছনে অবস্থিত নেটওয়ার্ক অবকাঠামোর বিকাশ না ঘটত। প্রথম দিকের মোবাইল ফোন পরিষেবায় কিছু সংখ্যক বৃহৎ রেডিও টাওয়ার ব্যবহার করা হত। অর্থাৎ, একটি বড় শহরের সকল গ্রাহক একটি কেন্দ্রীয় বেস স্টেশনের ওপর নির্ভর করত। আন্তর্জাতিক মোবাইল ফোন সেবায় কিন্তু তা ঘটে না।
প্রথম মোবাইল সেবা চালু হওয়ার পরই প্রকৌশলীরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে আরম্ভ করে। সমস্যাটির সমাধান করতে প্রায় চার দশক সময় লাগে। ১৯৮৩ সালে প্রথম সেলুলার বেস স্টেশনের মাধ্যমে সেলুলার ফোন সেবা চালু হয়।
সামরিক গবেষণা
সেলফোনের প্রতিটি যন্ত্রাংশ ও সহায়ক প্রযুক্তির উন্নয়ন ও গবেষণার পেছনে শত বছরের বাণিজ্যিক এবং সরকারি বিনিয়োগের ফলাফল আজকের এই মুঠোফোন। ফোনের উন্নত প্রযুক্তির বিকাশে একটি উল্লেখযোগ্য অংশের অর্থায়ন এসেছে সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে।
মোবাইল ফোনের বিকাশের পেছনে একটি বড় অনুপ্রেরণা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদলের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এসআরসি-৫৩৬ হ্যান্ডি-টকি ব্যবহার করে।
হ্যান্ডি-টকিটি ছিল মূলত দ্বিপাক্ষিক রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা। টকিটি সহজেই হাতে ধরা যেত বলে মুঠোফোনের অনুরূপ ছিল।
এসআরসি-৫৩৬ হ্যান্ডিটকির বিকাশ হয়েছিল মটোরোলা করপোরেশনের পূর্বসুরীদের হাতে। পরবর্তীতে, মটোরোলা অন্যতম বৃহৎ সেলফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
তবে, প্রযুক্তিখাতে সামরিক বিনিয়োগের ফলে যুগান্তকারী সব উদ্ভাবনের ঘটনা শুধু মুঠোফোনের ক্ষেত্রেই ঘটেনি। ইন্টারনেট এবং কন্ঠ শনাক্তকরণের মতো প্রযুক্তির পিছেও আছে সামরিক অবদান। সামরিক যন্ত্রাদি থেকে এই প্রযুক্তিগুলো বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে প্রসার লাভ করে।
তবে, ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ডিএআরপিএ) শুধুমাত্র এই প্রযুক্তিগুলোর পেছনেই নয়, বরং, ফোনের উন্নত যোগাযোগ অ্যালগরিদম, প্রসেসর, ইলেকট্রনিক মিনিয়েচারাইজেশন এবং ফোনের অন্যান্য প্রযুক্তির বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।
সামনে যা আসবে
প্রযুক্তির প্রতিটি জেনারেশনের পেছনে যুগ-যুগান্ত ধরে চলে আসা গবেষণা ও বিনিয়োগ থেকে সামনের দিনগুলোতে কী আসতে চলেছে সেই আন্দাজও করা যায়।
বর্তমানে বিদ্যমান বিভিন্ন যোগাযোগ প্রযুক্তি যেমন ফাইভ-জি, ওয়াইফাই, ব্লুটুথ ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড ভিত্তিক। অর্থাৎ, প্রতিটি প্রযুক্তি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসাধনের লক্ষ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে।
কিন্তু, গত ৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আরও উন্নত, অধিক সক্ষমতা সম্পন্ন এবং বহুমুখী প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ করে আসছে।
আর তাই ভবিষ্যতের মুঠোফোনগুলো কেবল উন্নত সিগন্যাল বা উচ্চ ডেটা রেট সমৃদ্ধ কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটারি সুবিধাই দিবে না। বরং, অন্যান্য বিভিন্ন কাজে রেডিওফ্রিকুয়েন্সিও ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
যেমন, রাডার সিগন্যালের মতো যোগাযোগ সিগন্যাল ব্যবহার করে হয়তো হাতের ইশারাতেই ফোন নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে ঘরের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা পরিমাপ করা এমনকি হার্ট রেট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হৃদজনিত সমস্যাও আগে থেকেই নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
প্রযুক্তি কোথায় নিয়ে যাবে সেই অনুমান করা সবসময়ই কঠিন। তবে, তা যেখানেই যাক, ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিও যুগ-যুগান্তরের গবেষণা আর বিকাশের ওপর নির্ভর করেই প্রতিষ্ঠিত হবে।
- সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন