ইভ্যালি পর্ব: যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধন্যবাদ প্রাপ্য
ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ। তবে বাংলাদেশে ইভ্যালি ও তার সমগোত্রীয় অন্যরা যা শুরু করেছিল, তাকে ব্যবসার ভবিষ্যৎ বলা চলে না। তারা যা করেছে, সেটি কেলেঙ্কারির সমতুল্য।
আর এই কেলেঙ্কারির ব্যাপারে তদন্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের তদন্তে উঠে এসেছে কোম্পানিটির কাজকর্ম কীভাবে গোটা আর্থিক ব্যবস্থাকে বিশৃঙ্খলায় ফেলার ঝুঁকি তৈরি করছে। যদিও ইভ্যালির সব হিসাব হাতে না পাওয়ায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। তবু, তদন্তের দুরূহ কাজটি করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ধন্যবাদ প্রাপ্য।
এই ই-কমার্স কোম্পানিগুলো যখন অবিশ্বাস্য রকমের লোভনীয় মূল্যছাড়ের লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল, তখন তাদের রক্ষা করার জন্য কোনো অভিভাবক নেই বলেই মনে হচ্ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অস্বাভাবিকভাবে পুরো একটি বছর লাগিয়ে দিয়েছে স্রেফ ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করতে।
যা-ই হোক, অবশেষে কর্তৃপক্ষের ঘুম ভেঙেছে। শেষতক অর্থ পরিশোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের অর্থ এখন কম ঝুঁকিতে থাকবে, কারণ এখন থেকে গ্রাহকদের পণ্য বুঝিয়ে দেওয়ার পরই কেবল ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে টাকা দেওয়া হবে।
এই প্রক্রিয়াটি যদি দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করা হয়, তবে দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে। কমে আসতে পারে প্রতারণার ঘটনা, ই-কমার্স সাইটগুলো হয়ে উঠতে পারে আরও দক্ষ ও কার্যকর।
কাজেই এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ এবং এই পদক্ষেপ নেওয়ায় ভূমিকা রাখার জন্য কৃতিত্ব প্রাপ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের। বিশেষ করে এমন এক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপটি নিল, যাখন অসংখ্য গ্রাহককে বেপরোয়া মূল্যছাড়ের অফার দিয়ে এই ই-কমার্স সাইটগুলো আর্থিক খাতকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইভ্যালির সম্পদ ও দেনার মধ্যে বিশাল যে পার্থক্য, তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনটি সমস্যার একেবারে মূলে আঘাত করেছে। এদিকে যেসব গ্রাহক পণ্যের জন্য টাকা পরিশোধ করে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও পণ্য বুঝে পাননি, তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য প্রতিষ্ঠানটির নেই।
গত ২২ জুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে 'Evaly...reckless or clever?' শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনটি ব্যাংকিং খাতকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তোলে।
বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের কার্ড ব্যবহার করে ইভ্যালি এবং আরও নয়টি ই-কমার্স কোম্পানির অগ্রিম অর্থ প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। আরও কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকদের সতর্ক করে বলে দিয়েছে, অনলাইন লেনদেনে প্রতারণার ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই গ্রাহকরা যেন তাদের কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে কেনাকাটা করার সময় সতর্ক থাকেন।
এসব ঘটনার জেরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও ই-কমার্স সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক জরুরি সভায় বসে। সভা থেকে ভালো ফলই এসেছে।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পণ্য সরবরাহের আগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো টাকা পাবে না। গ্রাহক পণ্য বুঝে পাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য একটি কোম্পানি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে টাকা আটকে রাখবে। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করা কোম্পানিটি পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ করবে।
তবে নতুন নিয়মটির সুফল পাওয়ার জন্য গ্রাহকদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। নিয়মটির কার্যকর প্রয়োগ এর ভাগ্য ঠিক করবে।
অতীতে শুধু যথাযথ প্রয়োগের অভাবেই অনেকগুলো ভালো উদ্যোগ মাঠে মারা গিয়েছিল।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দেশে তিন ডজনেরও বেশি আইন আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) অধ্যাদেশ, ১৯৮৫; বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪; এবং বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯। তবু একটি নতুন আইনের অভাব বোধ হচ্ছিল। তাই ২০০৯ সালে গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য আইনি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে প্রণীত হয় একটি সমন্বিত আইন—ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন।
তবে কিছু ব্যবসায় প্রতারণার ঘটনা ঘটার উদাহরণ প্রচুর আছে। কিছু ই-কমার্স কোম্পানি বেপরোয়া ছাড়ের অফার দিয়ে গ্রাহকদের জন্য ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। এসবের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক এবার যে ভূমিকা নিল, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব বাজারে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে ভূমিকা রাখা। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেওয়া সিদ্ধান্তটির যথাযথ প্রয়োগ হলে তা ই-কমার্সের সুস্থ বিকাশে অবদান রাখতে পারে।
অনুবাদ: মারুফ হোসেন
মূল লেখা ইংরেজিতে পড়ুন: