অগ্রিম মূল্য গ্রহণের ৫ দিনের মধ্যে পণ্যের ডেলিভারি নিশ্চিত করবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো
ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারিম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। পরবর্তী ৭২ ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারিম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে।
অর্থাৎ, ক্রেতার কাছ থেকে অগ্রিম পণ্যমূল্য গ্রহণের পাঁচদিনের মধ্যে পণ্যের ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে। তবে ক্রেতা ভিন্ন জেলা বা গ্রামে অবস্থান করলে মূল্য পরিশোধের ১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত খসড়া 'ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১'-এ এসব বিধান করে বলা হয়েছে, 'সর্বোচ্চ ৭২ ঘন্টার মধ্যে কোন পণ্য বা সেবা ডেলিভারিম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মত অবস্থায় না থাকলে সে ক্ষেত্রে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো ওই পণ্যমূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত এসক্রো সার্ভিসের মাধ্যমে ১০০% পর্যন্ত অগ্রিম গ্রহণ করা যাবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, অগ্রিম মূল্য আদায়ের ক্ষেত্রে অফারে প্রদর্শিত পণ্য অবশ্যই দেশের ভেতরে 'রেডি টু শিপ' (মার্কেট প্লেসের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে বা মার্কেটপ্লেসে নিবন্ধিত থার্ড পার্টি বিক্রেতার নিয়ন্ত্রণ) পর্যায়ে থাকতে হবে।
তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ডেলিভারির সময়সীমা আরও সংক্ষিপ্ত হবে এবং ক্রয়াদেশ গ্রহণের সময়ই ডেলিভারির সময় সুস্পষ্টভাবে ক্রেতাকে জানাতে হবে। কোন একটি ক্রয়াদেশে একাধিক পণ্য থাকলে আলাদা আলাদা ডেলিভারি চার্জ আরোপ করা যাবে না। তবে মার্চেন্ট ভিন্ন ভিন্ন হলে আলাদা ডেলিভারি চার্জ নেওয়া যাবে এবং ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করার আগেই তা ক্রেতাকে জানাতে হবে।
এই নির্দেশিকা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে সরকার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ভ্যাট নিবন্ধন বাতিল করাসহ সংশ্লিষ্ট মার্কেটপ্লেস নিষিদ্ধ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে। ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আদালতে আইনানুগ প্রতিকারের জন্য মামলা করতে পারবে।
খসড়াটি চূড়ান্ত করতে আজ বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডাকা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, আইন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)সহ ই-কমার্স ব্যবসায়ীরাও থাকবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও সরকারের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, খসড়াটি চূড়ান্ত করার পর মন্ত্রিসভার অনুমোদন ও প্রয়োজন হলে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং সাপেক্ষে খুব শিগগিরই এটি জারি করা হবে। এটি কার্যকর হলে ই-কমার্সখাতে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধান হবে বলে আশা করেন তিনি।
আলোচিত-সমালোচিত ই-কমার্স প্লাটফর্ম ইভ্যালির কার্যক্রম পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটির গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে বিপুল পরিমাণ দেনা থাকলেও তার মাত্র ১৬% পরিশোধের সক্ষমতা রয়েছে। এ বিষয়ে গত ২২ জুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিবেদন প্রকাশের পর এসক্রো সার্ভিস চালু ও ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা দ্রুত কার্যকর করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বিপুল হারে ডিসকাউন্টসহ গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার অফার দিয়ে ইভ্যালিসহ দেশের বেশকিছু ই-কমার্স কোম্পানি গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পরও সময়মত গ্রাহকদের পণ্য কিংবা রিফান্ড পরিশোধ করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
খসড়া নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, 'সকল ধরণের ডিজিটাল ওয়ালেট, গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার বা অন্য কোন মাধ্যম, যা অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া তৈরি, ব্যবহার বা ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ডিজিটাল মাধ্যমে কোন ধরণের অর্থ ব্যবসা পরিচালনা করা যাবে না।'
ই-কমার্স কোম্পানিগুলো যেসব পণ্য বিক্রির অফার দেবে, তা ওই ই-কমার্স কোম্পানি বা তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ মার্চেন্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। কোন পণ্য বিক্রির অফারে কি পরিমাণ পণ্য স্টকে আছে, তা উল্লেখ করতে হবে এবং প্রতিটি বিক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই পণ্যের স্টক আপডেট করতে হবে।
এতে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পর মানুষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোন কারণে ক্রেতার চাহিদামত পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব না হলে অর্ডার দেবার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তা ক্রেতাকে ফোন, এসএমএস বা ইমেইলে জানাতে হবে। এক্ষেত্রে অন্য কোন পণ্য কেনার জন্য ক্রেতাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধ্য করা যাবে না।
পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কোন ধরণের ডিসকাউন্ট, ফ্রি ডেলিভারি বা অন্য কোন সুবিধা থাকলে তা পরিষ্কারভাবে পণ্যের বর্ণনায় থাকতে হবে।
'যে কোন ধরণের ঘোষিত ডিসকাউন্ট বা ক্যাশব্যাক অফার বিক্রি কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করতে হবে এবং ক্যাশব্যাক অফারে ঘোষিত অর্থ পণ্য বা সেবা বিক্রি সম্পন্ন হওয়ার পর কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওয়ালেটে জমা রাখা যাবে না'- উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পণ্য ও সেবার বিষয়ে ক্রেতা যাতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করতে পারেন, সেজন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রেতা সংখ্যার অনুপাতে কাস্টমার কেয়ার কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। কোন পণ্য ও সেবার বিষয়ে ক্রেতার অভিযোগ রেকর্ডের যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং যেকোন অভিযোগ ৯৬ ঘন্টার মধ্যে সমাধান করে ক্রেতাকে জানাতে হবে।
খসড়া নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার সময় মুদ্রিত বিল প্রদান করতে হবে, যাতে প্রদত্ত ভ্যাট ও অন্যান্য কর (যদি থাকে) উল্লেখ করতে হবে।
খসড়া নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ক্রেতা ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক ট্রান্সফার, মোবাইল ব্যাংকিং বা অন্য কোন মাধ্যমে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলে এবং বিক্রেতা নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে মূল্য পরিশোধের সর্বোচ্চ ৭ দিনের মধ্যে ক্রেতার পরিশোধিত সম্পূর্ণ অর্থ একই মাধ্যমে ক্রেতাকে ফেরত দিতে হবে।
মূল্য ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন চার্জ থাকলে তা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে। তবে কোনভাবেই ক্রেতার পরিশোধিত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেওয়া যাবে না এবং মূল্য ফেরত দিয়ে তা ক্রেতাকে জানাতে হবে।
এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক এসক্রো সার্ভিস চালু করলে সময়মত ডেলিভারি না পেলে বা ক্রেতা কোন কারণে অর্ডার বাতিল করলে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোই ক্রেতাকে রিফান্ড পরিশোধ করবে। তখন ক্রেতার দেওয়া অগ্রিম মূল্য পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর তহবিলে জমা থাকবে এবং পণ্য ডেলিভারির পরই তা ই-কমার্স কোম্পানির একাউন্টে স্থানান্তর হবে। চলতি সপ্তাহেই এ সার্ভিস চালু করে সার্কুলার জারি করা হবে বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের জেনারেল ম্যানেজার মেজবাউল হক।
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সাবেক সভাপতি একেএম ফাহিম মাশরুর টিবিএসকে জানান, তিনি প্রস্তাবিত নির্দেশিকাগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। কেননা, সম্প্রতি তথাকথিত কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানির যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেসব সমাধানে নীতিমালায় উল্লেখ আছে।
"তবে আমি এটিও মনে করি যে, এই খাতে শৃঙ্খলা আনার জন্য শুধুই একটি নীতিমালা যথেষ্ট নয় বরং এর যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে", বলেন তিনি।