শুল্ক কর পরিশোধে আজ থেকে চালু হচ্ছে ই-পেমেন্ট
দেশের বৃহৎ শুল্ক স্টেশন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই (বৃহস্পতিবার) থেকে পুরোদমে চালু হচ্ছে ই-পেমেন্ট সিস্টেম।
এখন এই সিস্টেমে আমদানিকারকরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইউজার আইডি দিয়ে আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেলেটমেন্ট) গেইটওয়ের মাধ্যমে ঘরে বসেই শুল্ক পরিশোধ করতে পারবেন।
এতদিন মানুষকে ব্যাংকে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন ধরে শুল্ক কর পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
এই সিস্টেম চালু হওয়ায় দেশের আমদানি বাণিজ্যে জাল-জালিয়াতি, শুল্ক ফাঁকি, আমদানিকারকদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে শুল্ক কর বাবদ সিএন্ডএফ এজেন্টদের অতিরিক্ত অর্থ আদায়, আমদানি নথিপ্রতি কাস্টম এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের টাকা আদায়সহ সকল অনৈতিক কাজ বন্ধ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস একটি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে দুই লাখ টাকার বেশি শুল্ক কর আরোপ হলে বাধ্যতামূলক ই-পেমেন্ট করতে হবে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সব আমদানিকারকের জন্য ই-পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, 'ই-পেমেন্টের কারণে জাল-জালিয়াতির সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে সিএন্ডএফ এজেন্ট ভুল তথ্য দিয়ে আমদানিকারকদের কাছ থেকে শুল্ক বাবদ নির্ধারিত অংকের চেয়ে বেশি টাকা আদায় করতো। এখন আমদানিকৃত পণ্য চালানের বিপরীতে কত টাকা শুল্ক কর এল, তার সঠিক তথ্য আমদানিকারককে জানানো হবে'।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার (প্রিভেনশন) সুলতান মাহমুদ বলেন, 'ই-পেমেন্ট সিস্টেম নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস একাধিকবার প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। এতে আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্টস, শিপিং এজেন্টস, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এসোসিয়েশনসহ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন'।
তিনি আরো বলেন, 'আগে সোনালী ব্যাংকের কাস্টম হাউস শাখায় এসে শুক্র ও শনিবার ব্যাংকিং লেনদেনে আগ্রহী ছিল না সংশ্লিষ্টরা। ই-পেমেন্টের কারণে এখন যে কোন দিন শুল্ক পরিশোধ করতে পারবে। এতে সময় কমে যাবে'।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য মতে, প্রতিদিন গড়ে ৭ হাজার বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। এর মধ্যে ২ হাজার আমদানি পণ্যের এবং ৫ হাজার রপ্তানি পণ্যের। প্রতিদিন গড়ে ১২০ থেকে ১৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয় এই শুল্ক স্টেশনে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'ই-পেমেন্ট ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুল্ক কর পরিশোধ করতেই ব্যবসায়ীদের অনেক সময়ক্ষেপণ হতো। এখন এই সংকট কেটে গেছে'।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, নতুন এই নিয়মে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির পর আমদানিকারকের পক্ষে সিএন্ডএফ এজেন্ট শুল্ক স্টেশনে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করবে। শুল্কায়ন সেকশন থেকে নিশ্চিত করা হবে সংশ্লিষ্ট চালানটিতে কত টাকা শুল্ক কর পরিশোধ করতে হবে।
ই-পেমেন্ট সিস্টেমে আমদানিকারক দেশের যে কোন ব্যাংক থেকে শুল্ক পরিশোধ করতে পারবেন। তফসিলী ব্যাংকের যে শাখা থেকে শুল্ক পরিশোধ করা হবে সেই ব্যাংকের সাথে সোনালী ব্যাংক চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ শাখার মধ্যে গেইটওয়ে হিসেবে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরটিজিএস সিস্টেম। ই পেমেন্টের একমাত্র গেইটওয়ে সোনালী ব্যাংক। এসাইকুডা সফটওয়্যারের মাধ্যমে ( শুল্ক সংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সফটওয়্যার) আমদানিকারকের ইউজার আইডি ব্যবহার করে এই প্রক্রিয়ায় শুল্ক পরিশোধ করতে সময় লাগবে দুই মিনিট। ই-পেমেন্ট করতে ছয় ধরনের তথ্য প্রয়োজন হয়। বিল অব এন্ট্রি নম্বর, অর্থবছর, কাস্টম হাউজের অফিস কোড, পরিশোধকৃত শুল্কের পরিমাণ, এআইএন নম্বর এবং ফোন নম্বর। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শুল্ক পরিশোধ করা হলে আমদানিকারকের ফোন নম্বরে শুল্ক পরিশোধ সংক্রান্ত কনফার্মেশন এসএমএস পৌছে যাবে। আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসাইকুডা সফটওয়্যার নেটওয়ার্কে শুল্ক পরিশোধ সংক্রান্ত তথ্য আপডেট হবে।
আমদানিকারক এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট মালিকরা জানিয়েছেন, ই-পেমেন্ট সিস্টেমের কারণে কাস্টমস কর্মকর্তাদের অহেতুক হয়রানির পরিমাণও কমবে। বিভিন্ন সময় নানা জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে টাকা আদায় করত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের আইন বিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদিন রানা বলেন, 'পেপারলেস ডকুমেন্ট কনসেপ্ট বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে ই-পেমেন্ট সিস্টেম। শুল্ক পরিশোধে বিলম্ব হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সঠিক সময়ে পণ্য খালাসে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এতে সামগ্রিকভাবে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয় আমদানিকারক এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ই-পেমেন্ট সিস্টেমের কারণে এ সকল সংকট দূর হবে'।
সিএন্ডএফ এজেন্ট ওয়ারিশা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সরওয়ার আলম খান বলেন, 'আগের নিয়মে শুল্ক পরিশোধ করতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাংক বুথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো হতো। এতে সময় এবং অর্থ দুটোই অপচয় হতো। সরকারের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই'।
তবে চলতি জুলাই থেকে দেশের সব শুল্ক স্টেশনে ই-পেমেন্ট চালু হলেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এই সেবা চালু হয়েছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। ই- পেমেন্ট সিস্টেম চালু হওয়ার পর প্রথম দুই বছর মাত্র ১৬৩টি প্রতিষ্ঠান এই প্রক্রিয়ায় শুল্ক পরিশোধ করে।