আগের রঙে ফেরানো সম্ভব পাকা চুলকে!
বয়স বাড়ছে! আর তা বোঝার জন্য পাকা চুলের চাইতে স্পষ্টতর অন্য কিছু খুব কমই নজরে পড়ে। আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে কালো, বাদামি, লালচে কিংবা সোনালি চুলের সৌন্দর্যে ভাটা পড়ে; হারিয়ে যায় তাদেরও যৌবন। অনেকের কাছেই এটা একটা স্থায়ী ক্ষতি বলে প্রতীয়মান হলেও, নতুন করে গবেষণায় দেখা গেছে যে, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও চুল ধূসর হতে থাকার এই প্রক্রিয়াকে রুখে দেয়া যাবে।
চুল সাদা হতে থাকার এই সমস্যার বিষয়টি বহু দশক ধরে গবেষণা জগতে অন্ধকারেই পড়ে ছিল। ১৯৭২ সালে প্রয়াত ডার্মাটোলজিস্ট স্ট্যানলি কোমেইশ ৩৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন। অন্যসব মানুষের যেখানে হয় সব চুল পুরো সাদা হয়ে যেত কিংবা কালো থাকতো; সেখানে সেই ব্যক্তির তিনটি চুলের শেষ প্রান্ত সাদা ছিল এবং গোড়ার দিকে কালো ছিল। এটি দেখেই চুল স্বাভাবিকভাবে সাদা হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে কিছুটা সন্দেহ জাগে।
ইলাইফ-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাতে বিভিন্ন বয়স, জাত-গোত্র, লিঙ্গের ডজনখানেক মানুষ নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। গবেষকেরা চুল সাদা হওয়ার ধরন এবং দুশ্চিন্তায় থাকাকালীন সময়ে চুলে কী রকম পরিবর্তন আসে তাও পরীক্ষা করেছেন। স্পষ্টতই, চুল সাদা হওয়ার সঙ্গে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে।
মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডার্মাটোলজিস্ট ও গবেষণার সহ-লেখক রালফ পজ বলেন, 'এখন আমাদের সামনে একটা সুযোগের দরজা খুলে গেছে, যেখানে আমরা স্বাভাবিক চুল সাদা হওয়ার প্রক্রিয়ার উল্টোটা দেখতে পাবো।'
চার বছর আগে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইটোকন্ড্রিয়াল সাইকোবায়োলজিস্ট মার্টিন পিকার্ড একদিন ভাবছিলেন যে, আমাদের শরীরের কোষগুলো যেভাবে মাল্টিস্টেপ পদ্ধতিতে বেড়ে ওঠে, তাতে কারো কারো দেহে অন্যদের তুলনায় আগেভাগেই বৃদ্ধ হতে থাকার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তিনি তখনই বুঝতে পারলেন যে কোষীয় পর্যায়ে ভিন্নতার কারণেই সব চুল একসাথে সাদা হয় না।
'হয়তোবা এখান থেকেই আমাদের কিছু শেখার আছে। যে চুলগুলো আগে সাদা হয়, সেগুলো সম্ভবত অন্যদের চেয়ে বেশি নাজুক বা কম সজীব', বলেন পিকার্ড।
নিজের সহকর্মীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে পিকার্ড আরও বলেন, যদি কেউ খেয়াল করে যে তার একটা চুল সাদা হতে শুরু করেছে এবং সেই চুল কতটা দ্রুত লম্বা হচ্ছে তা হিসাব রাখতে পারলে হয়তো কি কারণে বয়ঃবৃদ্ধির প্রক্রিয়া আগে শুরু হচ্ছে সেই চুলে তা ধরা যাবে। তার কথা শুনে তার নারী সহকর্মী জানালেন, তার মাথায়ও তিনি দুইরঙা চুল দেখেছেন। তিনি তখনই বাথরুমে গিয়ে কয়েকটা চুল তুলে আনেন এবং তাদের প্রজেক্টটা সেখান থেকেই শুরু হয়।
এরপর পিকার্ড ও তার টিম মিলে দুইরঙা চুল আছে এমন ব্যক্তিদের খুঁজতে শুরু করলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিজ্ঞাপন বা সরাসরি যোগাযোগ করে তারা এরকম ১৪ জন নারী ও পুরুষকে পেলেন; এদের মধ্যে ৯ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষও ছিল এবং তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডও ছিল আলাদা আলাদা (যদিও অধিকাংশই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ)। তারা তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে শুধু সাদা বা দুইরঙা চুল উঠিয়ে দিলেন একটি করে। এরপর গবেষকরা চুলগুলোতে রঙ পরিবর্তনের পরিমাণ বুঝার জন্য ও ডিজিটাইজ করার জন্য একটি প্রযুক্তি বের করেন যাকে তারা বলছেন হেয়ার পিগমেন্টেশন প্যাটার্ন। এই প্যাটার্নের থেকে তারা বিস্ময়কর ফলাফল পান; অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯-৩৯ বছর বয়সী দশ জনের ধূসর হওয়া চুল আবার কালো হয়েছে। এটা শুধুমাত্র তাদের মাথার চুলেই নয়, বরং শরীরের অন্য অংশের চুলের ক্ষেত্রেও হয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট হেয়ার ফলিকলে চুল আবার কালো হওয়ায় এই পরিবর্তনগুলো হওয়ার সময়কালও নির্দিষ্ট হতে পারে।
অধিকাংশ মানুষ ত্রিশের কোঠায়ই পাকা চুলের সমস্যার সম্মুখীন হতে শুরু করে। অনেকের আবার ২০ বছর বয়স থেকেই তা শুরু হয়। পজ এর মতে, যখন চুল পাকার সমস্যাটা শুরু হয়, ঠিক তখনই এর উল্টোটা হওয়ার সুযোগও বেশি থাকে। যাদের মাথাভর্তিই পাকা চুল হয়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে চুল আবার কালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা বললেই চলে। তবে গুটিকয়েক হেয়ার ফলিকলের আবারও আগের রঙ এ ফিরে আসার কিছুটা সুযোগ থাকতেও পারে।
চুল সাদা হওয়া ও মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে যোগসূত্রের বিষয়টিও অনুসন্ধান করেছে এই দলটি। মানুষের স্বাস্থ্যের ইতিহাস জুড়ে সব জায়গায়ই এই দুটির মধ্যে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮ শতকে ফ্রান্সের রানী মারি অঁতোয়ানেতের গিলোটিনে ফাঁসি হওয়ার আগের রাতে একরাতের মধ্যেই মাথার চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল বলে কথিত আছে।
গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, চুল সাদা হওয়া বা উল্টো কালো অবস্থায় ফিরে আসার সাথে দুশ্চিন্তা কিংবা উদ্বেগমুক্ত সময় কাটানোর সম্পর্ক আছে।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৫ বছর বয়সী, পিঙ্গল বর্ণের চুলের অধিকারী এক পুরুষের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহের ছুটি কাটানোর সময়কালে তার মাথার ৫টি চুল সাদা থেকে আগের রঙে ফিরে এসেছে। ৩০ বছর বয়সী, কালো চুলের আরেক নারীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে দুই মাস তিনি বিবাহবিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে গেছেন, তখন তার চুলের কিয়দংশ সাদা হয়ে গেছে। বিবাহবিচ্ছেদের সেই সময়টাই ছিল ওই বছরে তার সবচেয়ে দুশ্চিন্তাযুক্ত সময়।
বর্তমানে দুশ্চিন্তা ও চুল পেকে যাওয়ার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আরও গভীরভাবে গবেষণা করার জন্য অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পজ, পিকার্ড ও তাদের সহকর্মীরা। পরবর্তী গবেষণায় তারা চুলের পরিবর্তন ও দুশ্চিন্তার মাত্রার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করবেন।
- সূত্র- সায়েন্টিফিক আমেরিকান