যে হাসপাতালে ডাক্তার নেই!
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার তারাবুনিয়া ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। এই হাসপাতালে রয়েছে বিশাল অবকাঠামো, আধুনিক সব যন্ত্রপাতি, ল্যাব আর অপারেশন থিয়েটার। কিন্তু প্রতিষ্ঠার দশ বছরেও চালু হয়নি হাসপাতালের কার্যক্রম। চরাঞ্চলের দুই লাখ মানুষের চিকিৎসার আশ্রয়স্থল এখন ধুঁকছে। করোনাকালে দেশের চিকিৎসা কার্যক্রম যখন জোরদার করা হচ্ছে তখনও অপহেলিত হাসপাতালটি। এতে স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। জনগণকে সেবা দিতে না পেরে অস্বস্তিতে স্বাস্থ্য বিভাগও।
শরীয়তপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলাটিতে ১৩টি ইউনিয়ন রয়েছে। যার মধ্যে ৯টি ইউনিয়ন পদ্মা নদীর চরাঞ্চল। চরাঞ্চলের ওই ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে ১৯৯৮ সালে সখিপুর থানা গঠন করা হয়। সখিপুর থানা সদরে কোন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স না থানায় চরসেনসাস ইউনিয়নের মাগন ব্যাপারীকান্দি গ্রামে একটি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই এলাকার তৎকালীন সাংসদ ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর উদ্যোগে তারাবুনিয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। ২০১০ সালে হাসপাতালটির যাত্রা শুরু হয়। প্রথম দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাসপাতালে কোন জনবল নিয়োগ না দেয়ায় স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা সীমিত পরিসরে বহিঃবিভাগ চালু করে। এরপর ২০১৫ সালের দিকে একজন চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়। ওই চিকিৎসক কিছু দিন কাজ করে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান।
হাসপাতালটিতে ৪ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ১ জন, সহকারী সার্জন ১ জন, সিনিয়র স্টাফ নার্স ৬ জন, এমটি ল্যাব ১ জন, ফার্মাসিস্ট ১ জন, অফিস সহায়ক ও নিরাপত্তা রক্ষীসহ অন্যান্য পদে আরো ১১ জনের পদ রয়েছে। কিন্তু ওই ২৫ জনের একজনও বর্তমানে হাসপাতালটিতে কর্মরত নেই।
২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর আরএমও পদে পদায়ন করা হয় অ্যানড্রিলা মনিষা চ্যাটার্জি নামে এক চিকিৎসককে। তিনি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে যোগদান করে ওই দিনই প্রেষণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফিজিওলজি বিভাগে চলে যান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যানড্রিলা মনিষা চ্যাটার্জি মুঠোফোনে জানান, 'আমি প্রেষণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ করব এমন শর্তেই তারাবুনিয়া ২০ শয্যা হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দুটি আদেশ এক সাথে নিয়েই আমি শরীয়তপুরে যাই। আবার ওই দিনই ঢাকা মেডিকেলে ফিরে আসি'।
সহকারী সার্জন হিসেবে ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর তাসনীম জাহান যুথিকাকে তারাবুনিয়া ২০ শয্যা হাসপাতালে পদায়ন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তিনি মাঝে মাঝে ওই হাসপাতালে যেতেন। বর্তমানে তিনি প্রেষণে ঢাকার কুর্মিটোলা ৫০০ শয্যা হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন।
তারাবুনিয়া ২০ শয্যা হাসপাতালটির দরজা যাতে একেবারে বন্ধ না হয়ে যায় তার জন্য শরীয়তপুরের স্বাস্থ্য বিভাগ একজন মেডিকেল অফিসার ও উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার প্রেষণে দিয়েছেন। কিন্তু তাদেরও দেখা মেলে কালেভদ্রে।
ভেদরগঞ্জের চরকুমারিয়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) বিপুল কুমার গাইন বর্তমানে ওই হাসপাতালে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, 'বহিঃবিভাগে কিছু রোগী আসেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করি'।
তারাবুনিয়া ২০ শয্যা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের দোতলা ভবনের পুরো দায়িত্ব মাত্র একজন কেয়ারটেকারের ওপরে। নেই কোন চিকিৎসক। কয়েকজন রোগীর সাথে কথা বলছেন কেয়ারটেকার আক্কাস আলী। এগিয়ে জানা যায় ডাক্তার নেই, সেই বিষয়টিই রোগীদের জানাচ্ছেন তিনি। কয়েকজন রোগী ওষুধ চাইলে, 'ওষুধও নেই' বলে খালি প্যাকেট দেখাচ্ছেন আক্কাস।
দোতলা ভবন ঘুরে দেখা যায় ভবনের বিভিন্ন অংশের দরজা-জানালার কাঁচ ভাঙা। আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যন্ত্রাংশগুলো প্যাকেট বন্দি। অপারেশন থিয়েটারটি এখনও পরিপাটি মনে হচ্ছে। কি নেই হাসপাতালটিতে! এক্সরে, ইউএসজি, ইসিজি, ল্যাব সুবিধা। নারী ও পুরুষ দুইটি আলাদা ওয়ার্ড। নার্সদের জন্য পৃথক কক্ষ। রয়েছে বিশাল জরুরী বিভাগ, অভ্যর্থনা কেন্দ্রও। কিন্তু সব কিছুতেই ধুলার আস্তরণ। বাসা বেঁধেছে মাকড়সা। একই প্রাঙ্গণে আরেকটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরো প্রাঙ্গণ হয়ে গেছে গরু-ছাগলের বিচরণভূমি।
হাসপাতাল থেকে ছোট্ট শিশু কোলে নিয়ে মলিনমুখে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন শাহিনা আক্তার। তিনি বলেন, 'আমার মাইয়্যার এক সপ্তা ধইরা জ্বর। কিছুতেই কমতাছে না। অনেক দূর থিকা চিকিসার নিগ্যা আইছিলাম। অনেকক্ষণ বইয়া রইছি। ডাক্তার নাই। অহন ফিরা যাইতাছিগা। মাইয়ারে কই নইয়া যাইমু আল্লাহ জানে'।
খালাসিকান্দি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব সেকান্দার হাওলাদার। গত তিন দিন ধরেই হাসপাতালে আসছেন চিকিৎসা নিতে। কিন্তু চিকিৎসকের দেখা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন বাড়ি। তার সাথে কথা হলে ক্ষোভের সাথে তিনি বলেন, 'যন্ত্রপাতি সরকার সব দিছে। দিলেও অহন তো কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা কিছু অইতাছে না। কাজে আইলে কোনো উফুকার অয় না। বড় হাসপাতাল বানাইছে। সব কিছু বানাইছে কিন্তু ডাক্টার নাই, লোক নাই, অসুদ নাই। সব কিছু পইরা পইরা নষ্ট অইতাছে। আমাগো কোনো উফুকারে আইতাছে না। তয় কিল্লিগ্যা এইড্যা বানাইলো আর আমাগো ধোঁকা দিলো'?
হাসপাতালটি নির্মাণ করতে জমি দান করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন ও তার স্বজনেরা। তাদেরই একজন খোকা ব্যাপারী। তিনি বলেন, 'জমি দিয়েছি চরাঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের জন্যই। সরকার সুন্দর হাসপাতালও বানিয়েছে। বলা যায় আধুনিক সব সুযোগ সুবিধাই আছে হাসপাতালটিতে। কিন্তু যাদের জন্য নির্মাণ করা হলো শুরু থেকেই তারা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন শুধুমাত্র জনবলের অভাবে। এই অঞ্চলের ৯টি ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ মানুষ এই হাসপাতালের চিকিৎসার জন্য অপেক্ষায় কিন্তু করোনার এই সময়েও সবাইকে যেতে হচ্ছে চাঁদপুর নয়তো ঢাকায়। কি আফসোস!'
শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন আব্দুল্লাহ আল মুরাদ বলেন, 'ওই হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য ২৫ জনের জনবল কাঠামো। কিন্তু একজনও পদায়ন করা হচ্ছে না। যে দুজন চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়েছিল তারাও প্রেষণে ঢাকায় চলে গেছেন। বদলি ও পদায়ন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে করা হয়। আমরা অনেক বার চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম হাসপাতালের জনবল পদায়নের জন্য। কিন্ত কোন সাড়া পাচ্ছি না'।