মামলা জটিলতায় আটকে আছে শরীয়তপুরে নতুন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উদ্বোধন, দুর্ভোগে রোগীরা
হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখনও চালু হতে পারেনি শরীয়তপুরে নবনির্মিত নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এতে যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার সাধারণ মানুষ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টে করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত হয়ে যায় নড়িয়া সদরে ৬ একর জমির ওপর ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই স্থাপনার উদ্বোধন।
নড়িয়া উপজেলা সদর থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার দূরত্বে মুলফৎগঞ্জ এলাকায় ১৯৬২ সালে নির্মিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির তিনতলা ভবন ২০১৮ সালে পদ্মা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়।
৫০ শয্যার ওই কমপ্লেক্সের বাকি সবকটি ভবন ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে। তখন এক বছরের মতো সময় ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়।
এরপর ওই জায়গা থেকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
পরে নড়িয়া উপজেলা সদরে ৬ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় নতুন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৪তলা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন, চিকিৎসকদের ডরমেটরি, নার্স ডরমেটরি, স্টাফ কোয়ার্টার, বিদ্যুতের সাবস্টেশন, গ্যারেজসহ ৮টি ভবন নির্মাণ করতে খরচ হয় ২৮ কোটি টাকা। এছাড়া ৬ একর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে আরও ২৩ কোটি টাকা।
গত জুনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শেষ করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ১ সেপ্টেম্বর এটি চালু করার কথা ছিল।
তবে এতে বাধ সাধেন স্থানীয় কিছু বাসিন্দা। শুরু থেকেই তারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জায়গা স্থানান্তরের বিরোধীতা করে আসছিলেন।
তাদের দাবি, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি মুলফৎগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলে এটি কেন্দ্র করে এলাকায় গড়ে ওঠা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হবে। জীবন-জীবিকার সংকটে পড়বেন এই ব্যবসায়ীরা। মূলত এ কারণেই তারা শুরু থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেন নড়িয়ার চরজুজিরা এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী মাসুদ দেওয়ান।
পরে ৯ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্যা ও বিচারপতি কাজী জিনাত হক পরবর্তী ৬ মাসের জন্য ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করার আদেশ দেন।
এরপর থেকে নতুন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চালু করার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয়দের পক্ষে আদালতে মামলাকারী শরীয়তপুর জজ কোর্টের আইনজীবী মাসুদ দেওয়ান বলেন, "এটা আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। সেই ১৯৬২ সাল থেকে এই হাসপাতালের কার্যক্রম হয়ে আসছে। এখানকার মানুষজন এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন। এখন বাঁধ নির্মাণ হয়েছে, ঝুঁকি কমেছে— তাহলে কেন হাসপাতাল সরিয়ে নেওয়া হবে? এজন্যই আমরা প্রতিবাদ করছি। আইনের আশ্রয় নিয়েছি।"
এদিকে, মুলফৎগঞ্জে অবস্থিত নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, ৩তলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনটি বিলীন হওয়ার পর পাশের একটি দোতলা ভবনে স্বল্প পরিসরে রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে।
ওই ক্যাম্পাসের স্টাফ কোয়ার্টারে জরুরি বিভাগ ও বহিঃবিভাগ চালানো হচ্ছে। তবে ভবনের অভাবে অস্ত্রপচার, এক্সরে ও প্যাথলজি বিভাগ চালু করা যাচ্ছে না। ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও মূল ভবন না থাকায় ২০টি শয্যায় আন্তঃবিভাগের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, "এক কথা বলতে গেলে, আমাদের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়েই স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের বাসভবনগুলোতে ইমার্জেন্সি আউটডোর, অফিস, ওটি এবং প্যাথলজি– এগুলো স্বল্প পরিসরে চালিয়ে যাচ্ছি। ১৪টা ইউনিয়ন ও একটা পৌরসভার সব রোগী আমাদের পুরাতন হাসপাতালে আসতে পারছেন না। এখন নতুন হাসপাতালটা চালু হলে ওখানে নড়িয়ার সব প্রান্তের লোক সহজে চিকিৎসা নিতে পারবেন।"
দীর্ঘক্ষণ বহিঃবিভাগের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কেদারপুরের হাবিবুর রহমান বলেন, "হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হয়, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। শীতের দিনে কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডার মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা লাগে। রুমের ভিতর ঢুকলে কখন যে ডাক্তার দেখিয়ে বের হতে পারব, তারও কোনো ঠিক থাকে না।"
ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতাল ভবনে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাত্তার মিয়া। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি বলেন, "৩দিন ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি। ছাদের উপর থেকে মাঝে মাঝেই সুরকি পড়ে। নদীর পাড়ে এমন দুর্বল ভবনে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। ভয় হয় চিকিৎসা নিতে এসে কখন না নদীর মধ্যেই ভবন চলে গিয়ে এখানেই মরে যাই!"
নড়িয়া পৌরসভা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মায়া রানী জানান, "নদীর পাড়ে ভাঙ্গা বিল্ডিংয়ে চিকিৎসা নিতে ভয় তো লাগেই; কিন্তু উপায় নেই। ভবন থাকলেও নতুন হাসপাতালে কোনো ডাক্তার, কোনো চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে এই নদীর পাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতাল ভবনে চিকিৎসা নিচ্ছি।"
"নতুন ওই হাসপাতাল খুলে দিলে আমাদের জন্য অনেক উপকার হতো," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, পুরাতন ভবনটি একেবারেই নদী তীরবর্তী এলাকায় হওয়ায় যেকোনো সময় দুর্ঘটনার স্বীকার হতে পারে এমন বিবেচনায় প্রকৌশলীরা নদীর তীর থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরত্ব রেখেই নতুন এ হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করেছেন। ওই হাসপাতালের দামি দামি রোগ নির্ণায়ক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ নিয়েও দেখা দিয়েছে জটিলতা।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর শরীয়তপুর কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী সাব্বির আহম্মেদ সিদ্দিকী বলেন, "নদী থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই বহুতল স্থাপনা নির্মাণ করা প্রকৌশল বিদ্যা অনুযায়ী যথার্থ। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এড়িয়েই সরকার বহুতল ভবন ও স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দেয়। আর সে অনুযায়ীই উপজেলা শহরে হাসপাতালটি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।"
"এখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়েছে। আমরা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু উচ্চ আদালতে মামলার কারণে তারা বুঝে নিতে পারছে না। ভবন ও মালামাল এভাবে ফেলে রেখে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাড়ছে। এসব নিয়ে বিপাকে আছে কর্তৃপক্ষ," যোগ করেন তিনি।