ছিলেন প্রধান শিক্ষক, করোনা পরিস্থিতিতে হলেন রাখাল
ছিলেন একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। সেই শিক্ষক এখন গরুর খামারের কর্মচারী। একসময় যার হাতে থাকতো চক-ডাস্টার, ব্যস্ত সময় কাটাতেন মানুষ গড়ার কাজে, আজ তিনিই করেন রাখালের কাজ। করোনায় বন্ধ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই এমন পরিণতি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আল হেরা একাডেমীর প্রধান শিক্ষক আজিজুল হকের।
ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল কালামের খামারে গেলে দেখা মিলবে শিক্ষক আজিজুল হকের। করোনা পরিস্থিতিতে পাল্টে গেছে তার এতদিনকার জীবন। অভাবের তাড়নায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করা এই শিক্ষক পেশা বদলে এখন ব্যক্তিমালিকানাধীন গরুর খামারের কর্মচারী।
আজিজুল হক জানান, স্কুল বন্ধ, কবে খুলবে তার কোন ঠিক নেই। বেসরকারি স্কুল হওয়ায় ছাত্রদের বেতনের উপরই নির্ভর করতেন। তাই বিপাকে পড়েছেন তিনি। প্রথমে হাজার টাকা বেতনে ত্রিশাল বাজারে একটি দোকানে কিছুদিন কাজ করেন। পরে তিন মাস হলো, আট হাজার টাকা বেতনে খামারে কাজ শুরু করেছেন।
ত্রিশাল উপজেলার সদর ইউনিয়নের মধ্য পাঁচপাড়া গ্রামের মৃত আজমত আলীর বড় ছেলে আজিজুল হক রশিদ ১৯৯৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। তারপর বিএ পড়া অবস্থায় গড়ে তোলেন মডার্ন কোচিং সেন্টার। আজিজুল হক ১৯৯৮ সাল থেকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০০০ সালে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন আল হেরা একাডেমী।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো ধরনের দান-অনুদান ছাড়া শিক্ষার্থীদের বেতনের মাধ্যমেই এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন আজিজুল হক। প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্কুলটি চালাচ্ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, "কোন কাজই ছোট নয়। তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চক-ডাস্টার রেখে খামারে কাজ করে রোজগার করতে হবে, এটা আমার জন্য কষ্টকর। আমার ছাত্ররা বুয়েট, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে। সৎ থেকে সারাজীবন ছাত্র পড়িয়েছি, আর এবার মহামারি করোনা আমাকে জীবনের সব থেকে বড় শিক্ষা দিল"।
করোনাকালীন সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় নিজের ৪ শতাংশ জমি বিক্রি করে অন্যান্য শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করেছেন বলেও জানালেন।
স্ত্রী ও এক কন্যা নিয়ে শিক্ষক আজিজুল হকের সংসার। স্ত্রী আমেনা বেগম গৃহিণী, মেয়ে আছিয়া খাতুন তার স্কুলেই চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
আমেনা বেগম বলেন, "সংসারে অভাব-অনটন নতুন কিছুনা। সারাটা জীবন স্কুল-স্কুল করে টাকাপয়সা শেষ করেছে। শেষ পযর্ন্ত স্কুলটাই বন্ধ হয়ে গেল। করোনা পরিস্থিতি আমার স্বামীর শিক্ষকতা পরিচয়টাও কেড়ে নিল"।
আল হেরা একাডেমী ত্রিশাল বাজারের ভাটিপাড়া এলাকায়। ১ম শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে। স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় দুইশ জন। শ্রেণিভেদে ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেতন নেয়া হয়। শিক্ষক আছেন ১২ জন, যাদের মধ্যে নারী শিক্ষক ৮ জন।
স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেনের বাবা আব্দুল হামিদ বলেন, "স্কুলটি বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় ছেলেকে ভর্তি করেছিলাম। করোনার কারণে এখন সব ব্ন্ধ। প্রধান শিক্ষক ভবিষ্যতে স্কুল চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। যদি এমন হয়, তাহলে ছেলেকে অন্য স্কুলে দিয়ে দিব"।
দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ তানজিত হোসেনের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, " স্কুল মনে হয়না ঠিকভাবে চলবে। তাই ছেলেকে আর দিচ্ছিনা ঐ স্কুলে"।
আরও পড়ুন- কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক এখন হোমিও চিকিৎসক
খামারের মালিক আব্দুল কালাম জানান, "শিক্ষক আজিজুল হককে আমরা সবাই চিনি। ছাত্র পড়ানোর ক্ষেত্রে তার সুনাম আছে। অভাবে পড়ে আমার কাছে এসেছে চাকরির জন্য। আমি প্রথমে রাজি হইনি। তারপর তার অনুরোধে চলমান অবস্থা দেখে চাকরি দিয়েছি। আমি নিজেও ভাবছি, তার জন্য অন্য কোন কিছু করা যায় কিনা"।
ত্রিশালের সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোছাঃ মোস্তাহিদা পারভিন বলেন, "বেসরকারি স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনগুলো আমরা দেখাশোনা করে থাকি। আল হেরা একাডেমী আমার দায়িত্বরত এলাকার মধ্যেই পড়ে। যারা কিন্ডারগার্টেনে পড়ান, তাদের চাকুরি যেহেতু সরকারী নয় তাই বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। শিক্ষক আজিজুল হককে আমি চিনি। তার সমস্যার বিষয়ে কতটুকু কী করা যায় আমি চেষ্টা করবো"।
ত্রিশাল উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ জানান, "বিষয়টি আমার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জেনেছি। শুধু আজিজুল হক নয়, তার মতো যারা আছেন সেসব শিক্ষকদের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করছি। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে জানিয়েছি"।
ত্রিশাল উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি আব্দুল মতিন সরকার বলেন, "করোনাকালীন সময়ে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থা বেশি খারাপ। এদের বড় অংশ না পারে হাত পাততে ,না পারছে অন্য চাকরিতে যেতে। সমস্যাটা সবার। তবে আজিজুল হকের করুণ অবস্থা সত্যিই আমাদের জন্য কষ্টদায়ক"।
ত্রিশাল পৌরসভার মেয়র এবিএম আনিসুজ্জামান বলেন, "বিষয়টি আমি শুনেছি। এটি অত্যন্ত মানবিক। আমি চেষ্টা করবো এই শিক্ষকের জন্য কিছু করার"।