বাঁকখালী নদী দখলে কক্সবাজার পৌরসভাও
প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অবৈধ দখল অব্যাহত থাকায় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে কক্সবাজারের এক সময়ের খরস্রোতা বাঁকখালী নদী। দু’পাড় সংকুচিত হয়ে পর্যটন শহরের মিঠাপানির প্রাণ এ নদী ক্রমেই ছোট খালে পরিণত হচ্ছে। নদী তীর ভরাট ও অবৈধ দখলে জড়িতদের সনাক্ত করে মামলা করা হলেও থেমে নেই দখল। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অজানা কারণে থেমে আছে উচ্ছেদ কার্যক্রমও।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে ১০৯ জন দখলদারের পরিচিতি দিয়েছে। এর মাঝে কক্সবাজার পৌরসভাকেও দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ১৫৭ প্রভাবশালীসহ ৪২০ জন দখলদারকে চিহ্নিত করেছে। এরপরও দখলদারদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজারের প্রাণ বাঁকখালী নদী গিলে খাচ্ছে অবৈধ দখলদাররা। ভূমিদস্যুদের পরিকল্পিত দখলে দু’তীরে গড়ে উঠেছে চিংড়ি ঘের, লবণমাঠ, পোল্ট্রি খামার, চাল ও ময়দার মিল, ঘরবাড়ি-দোকানপাটসহ কয়েকশ’ স্থাপনা। পৌর কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের হাত থেকেও রেহাই পাচ্ছে না বাঁকখালী। নদীকে আবর্জনার ভাগাড় বানিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। শহরের সিংহভাগ ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলায় গতিপথ এখন সংকুচিত। পলিথিনসহ নানা বর্জে ধ্বংস হচ্ছে প্যারাবন।
দখল ও ময়লা ফেলার ব্যাপারে কক্সবাজার পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘‘ময়লা ফেলা জমিটি পৌরসভার কেনা খতিয়ানি জমি। স্থায়ী একটি ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ বা ক্রয়ের চেষ্টা চলছে। এটি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বাঁকখালী তীরে একযুগ আগে ক্রয় করা জমিটি ব্যবহার হচ্ছে। এটি দখল করা জমি নয়।’’
বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকায় শীর্ষ ঠিকাদার সিআইপি আতিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবদুল খালেক চেয়ারম্যান, জামায়াত নেতা জাহাঙ্গীর কাশেম, আবদুল্লাহ খান, শামশুল হুদা, শহর মুল্লুক, ফরিদুল আলমসহ ১৫৭ প্রভাবশালীর নাম রয়েছে। পাশাপাশি ছোট-মাঝারি মিলিয়ে তালিকায় স্থান পেয়েছে ৪২০ জন দখলদার। তবে পিতার নাম ও ঠিকানা না থাকায় এ তালিকা পূর্ণাঙ্গ নয়। প্রভাবশালীদের রক্ষায় দায়সারা তালিকা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের।
তাদের দাবি, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সুশীল সমাজ ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি থাকলেও প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ না থাকার অজুহাতে উচ্ছেদকে এড়িয়ে যাচ্ছে প্রশাসন।
পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’ এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, ‘‘বাঁকখালীর তীর দখলদারদের উচ্ছেদে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তহবিল বরাদ্দ না থাকার কথা বলে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় না। প্রশাসনের নীরবতায় দখলকারীরা বেপরোয়া হচ্ছে। প্রশাসন চাইলে যেকোন সময় আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে।’’
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, বাঁকখালী নদীকে ঘিরে কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকা- বহুকাল থেকেই। নদীটির কস্তুরাঘাট, বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতো বড় বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ আর মালাবাহী ট্রলার। মানুষের আনাগোনায় কোলাহল ও কর্মচাঞ্চল্য ছিল এসব ঘাটে। দখল আর দূষণে নাব্যতা হারিয়ে আজ জৌলূসহীন বাকঁখালী নদী।
সরকারি দলের ছত্র ছায়ায় ভূমিদূস্যরা বাঁকখালী দখলে দিন দিন বেপরোয়া হয়েছে উঠেছে। অনেক ভূমিদস্যু লিজ নেয়ার বাহানায় সু-কৌশলে ময়লা-আর্বজনা ফেলে নদী ভরাট আর জেগে ওঠা চর অবৈধভাবে দখল করছে। সবুজ ম্যানগ্রোভ বন কর্তন করে নষ্ট করা হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
এ বিষয়ে কক্সবাজারে একটি সভায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেছিলেন, দেশের বিদ্যমান আইনে নদী ইজারা দেওয়ার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি। কেউ কোনো দলিলমূলে নদী দখল করলেও আইনত তা অবৈধ। এই দলিল বাতিল করার ক্ষমতা জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনায় বাঁকখালীর দখলদারদের ৪২০ জনের তালিকা করা হয়েছে। আর সীমানা নির্ধারণে সিএস জরিপের কথা বলেছেন হাইকোর্ট। কিন্তু জেলার নদীগুলোতে সিএস জরিপ হয়নি। বিষয়টি হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে। আরএস বা বিএস জরিপের কোনো একটার ভিত্তিতে নদীর সীমানা নির্ধারণের নির্দেশনা পেতে হাইকোর্টকে অনুরোধ করা হয়েছে। নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়াম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ বলেন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বোর্ডের ৬নং কার্যাবলী হল- সমুদ্র সীমার মধ্যে কেউ যদি কোনো নির্মাণ কাজ করে সেটাকে অপসারণ বা উচ্ছেদ করা। বাঁকখালীর বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে সহযোগিতার আশ্বাসও দেন তিনি।