তেহরানে মসজিদের চূড়ায় যুদ্ধের লাল পতাকা
বাগদাদে মার্কিন হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধের ইঙ্গিত জানিয়ে দেশটির কম প্রদেশের পবিত্র মসজিদের চূড়ায় যুদ্ধের লাল পতাকা উড়িয়েছে তেহরান। এটিই প্রমাণ করে যে- তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
শিয়াদের পবিত্র নগরী কম প্রদেশের পবিত্র জামকারান মসজিদের সর্বোচ্চ গম্বুজে লাল পতাকা উড়িয়েছে ইরান। ঘটনাটি ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
জামারকরন মসজিদটি শিয়া ইসলামের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত এবং এটি ভবিষ্যতে মাহদীর পুনর্বার আগমনের সাথেও জড়িত।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়। পতাকাটিতে লেখা ছিল, ‘যারা হোসাইনের রক্তের বদলা নিতে চায়’। অর্থাৎ কারবালার যুদ্ধের প্রতীক এই পতাকা।
শিয়া ঐতিহ্যের এই লাল পতাকা ওড়া- অন্যায়ভাবে হত্যা এবং মৃত ব্যক্তির প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান- এই উভয়ের প্রতীক হিসাবে কাজ করে। আর এটি আমেরিকার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার সতর্কতার বার্তা নিয়ে এসেছে।
মার্কিন ড্রোন হামলায় সুলেইমানির মৃত্যুর পর এখন আমেরিকা-ইরান যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব পড়তে পারে গোটা পশ্চিম এশিয়ায়।
গত শুক্রবার বাগদাদ বিমান বন্দরে একটি ড্রোন হামলায় ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলেইমানি ও ইরানি সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া নেতা আবু মাহদী আল-মুহান্দিস নিহত হওয়ার পর ইরান তার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করে।
ইরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে ট্রাম্প জানান, ‘প্রতিশোধ নিতেই মার্কিন দূতাবাসে হামলা ৷ মার্কিন সম্পত্তির ওপর হামলার পরিকল্পনা ৷ মার্কিনিদের ওপর হামলা হলে রেহাই পাবে না ৷ ইরানের ৫২টি জায়গা টার্গেটে রয়েছে ৷ আমেরিকা আর কোনও হুমকি চায় না ৷ খুব তাড়াতাড়ি জবাব পাবে ইরান ৷’
তবে ইরানও পিছিয়ে নেই। এরই মধ্যে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি থেকেও বেরিয়ে এসেছে ইরান ৷ আর এখন তো যুদ্ধের নিশানও উড়িয়ে দিয়েছে তারা।
বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের দাবি, ইরানের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। তাঁদের মতে, এর অর্থ— দেশের জনগণকে যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকতে বলা।
বিক্ষোভে টালমাটাল ইরাকে এক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা চলছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে। গত ২৭ ডিসেম্বর ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেসের (হাশদ আল-শাবি) শাখা কাতায়েব হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় মার্কিন এক ঠিকাদার নিহত হন। তার দু’দিন পর যুক্তরাষ্ট্র আল-শাবির ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ২৫ জনকে হত্যা করে।
এর প্রতিবাদে আল-শাবির সদস্যরা মিছিল নিয়ে বাগদাদের গ্রিন জোনে (পশ্চিমা দেশগুলোর ঘোষিত কথিত আন্তর্জাতিক জোন) ঢুকে মার্কিন দূতবাসে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
তারপর গত শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ভোরে বাগদাদ বিমানবন্দরে হামলা চালিয়ে জেনারেল সোলেইমানি ও আল-শাবির উপ-প্রধানসহ আটজনকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন বাহিনী তাকে হত্যা করায় ‘চরম প্রতিশোধ’ নেয়ার হুমকি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি। এমনকি দেশের আকাশসীমায় যুদ্ধবিমানও মোতায়েন করেছে তেহরান। ইরানের এই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটিগুলোতে আরও সাড়ে ৩ হাজার সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এরই মধ্যে তেহরান যুক্তরাষ্ট্রকে আঘাত করতে ৩৫ স্থাপনা টার্গেট করার কথা বললে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উল্টো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ৫২ স্থানকে টার্গেট করেছে।
শুধু তাই নয়। মধ্যপ্রাচ্যের ১১ টি দেশে ৭০ হাজারের বেশি মার্কিন সৈন্য মোতায়েন আছে। কিন্তু ইরানও কাঁচা খেলোয়াড় নয়। তার হাতেও অস্ত্র আছে।
হরমুজ প্রণালী একটি সরু জলপথ যা আরব উপদ্বীপকে ইরান থেকে পৃথক করেছে। ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই চ্যানেলটি পারস্য উপসাগরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ওমান ও ইরানকে সংযুক্ত করেছে।
এই রুটটি আন্তর্জাতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তেলবাহী জাহাজ যাতায়াতের এটিই একমাত্র পথ। হরমুজ দিয়ে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেলের মতো তেলজাতদ্রব্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এর সঙ্গে আছে তরলীকৃত গ্যাসও।
মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মতে, ২০০৯ সালে সমুদ্রপথে তেল বাণিজ্যের ৩৩ শতাংশ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে এবং ২০০৮ সালে হয়েছিল ৪০ শতাংশ।
শনিবারই রাজধানী তেহরানে সুলেইমানির মেয়ের সঙ্গে দেখা করেন সেদেশের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। তার বাবার মৃত্যুর বদলা নেওয়ারও আশ্বাস দেন।
এদিনই সুলেইমানির কফিনবন্দি দেহ নিয়ে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মিছিল করেন তার সমর্থকরা। গাজায় মার্কিন বিরোধিতায় মিছিল করেন ফিলিস্তিনীরাও। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে, উপসাগীয় যুদ্ধের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।