কারখানায় অগ্নিকাণ্ড: বিচার হয় না, নেই ক্ষতিপূরণও
কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ীদের বিচার হয় না। এসব ঘটনায় নিহদের পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার নজির নেই। আবার ক্ষতিপূরণ দিতে বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিলেও বাস্তবায়ন হয় না।
এসব মামলার আসামীরা জামিন নিয়ে দিব্যি ব্যবসা পরিচালনা করে। অভিযোগ রয়েছে, জামিনে থেকে মামলার বিচারে বিলম্ব করানোর জন্য নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছে তারা।
অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের পরিবার দুস্থ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়, আহতদেরও একই অবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব ঘটনার বিচার করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে পারলে কারখানায় এরকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় ভয়াবহ আগুনে ১১২ জনের মৃত্যু ও দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। ওই দুর্ঘটনায় মামলা হলেও বিচার শেষ হয়নি আজও।
২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির এমডি দেলোয়ারসহ ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে মৃত্যুর পিছনে অবহেলা ও হত্যাচেষ্টার দায়ে ঢাকার আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। এই মামলায় ১০৪ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ২০১৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ৮ জন সাক্ষ্য দিয়েছে আদালতে। মামলাটি এখন ঢাকা জেলার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এই মামলার সব আসামি জামিনে রয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা যায়।
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল মান্নান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মামলার অভিযোগপত্রে অধিকাংশ সাক্ষীর বর্তমান ঠিকানা দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমান ঠিকানায় অনেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব সাক্ষীর স্থায়ী ঠিকানা দেয়া হয়েছে, তারা সঠিকভাবে আদালতের সমনও পাচ্ছেন না। তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না।'
তবে এই মামলায় সাক্ষী হাজির করতে রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি রয়েছে বলে জানান মানবাধিকার আইনজীবী জেডআই খান পান্না। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসের (ব্লাস্ট) সহায়তায় এসব মামলা হয়েছে'।
তিনি বলেন, 'এই মামলাটিতে নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে বিচার বিলম্ব করা হচ্ছে। দেখা যাবে, বিলম্বের কারণে একসময় এই মামলাটি হারিয়ে যাবে। নিহত ও আহতরা ন্যায় বিচার না পাওয়ার একটা বড় সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে'।
তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ড: এক টাকাও ক্ষতিপূরণ পায়নি নিহতদের পরিবার ও আহতরা
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের বুড়িপাড়ার মনোয়ারা বেগম ও তার স্বামী কাজ করতেন তাজরীন ফ্যাশনসে।
অগ্নিকাণ্ডের সময় ওই ভবনের তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে মনোয়ারা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার দুই পা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা যায় তার স্বামী। মনোয়ারা এখনো ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। নিজের চলাফেরার কাজটুকই করতে পারেন শুধু।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'স্বামী হত্যারও বিচার পেলাম না, ক্ষতিপূরণও পেলাম না। এখন পুরোই অসহায়'।
তাজরীন ফ্যাশনসের সুইং অপারেটর ছিলেন মোছাম্মত জরিনা। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রাণ বাঁচাতে কারখানার তিনতলা থেকে নিচে লাফ দেন। পঙ্গুত্বের সঙ্গে এখন তার বসবাস। তিনি বলেন, 'আমার ডান পা ও ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়। ৯ বছর ধরে কোনো কাজ করতে পারি না। আমার পাশে যারা ছিল তাদেরও একই অবস্থা। আমরা কোনো ক্ষতিপূরণও পাইনি। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে জীবন পার করছি।'
আমলে নেওয়া হয়নি হাইকোর্টের নির্দেশনা
ওই অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতের নির্দেশনা চেয়ে আসক ও ব্লাস্টসহ চারটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট করে।
রিটের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট নিহত ও আহতদের জন্য কেন যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করে।
একইসাথে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে তাজরীনে অবহেলা ক্ষতিয়ে দেখা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে বলা হয় সরকারকে। এরকম ঘটনা প্রতিরোধে কি ধরনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, সেটি নিরূপন করে ছয় মাসের মধ্যে আদালতে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
ব্লাস্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শারমিন আখতার টিবিএসকে বলেন, 'রুল জারির পর এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো শুনানি হয়নি। এখন পর্যন্ত সরকারের সংশ্লিস্টরা এ নিয়ে কোনো প্রতিবেদনও আদালতে দেয়নি বা ক্ষতিপূরণ দিতে কি ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা নিয়েও কোনো তথ্য হাইকোর্টে আসেনি'।
কেটিএস টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস
২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বিএসসিআইসি শিল্প এলাকায় কেটিএস টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে ৫৭ জন শ্রমিক নিহত হয়, আহত হয় শতাধিক। ওই ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায়ে মামলা হলেও, পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটির মালিক পক্ষকে বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশীট দেয় পুলিশ। এখন পর্যন্ত সেই মামলার বিচার শেষ হয়নি।
নিহত ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে ওই বছরের মার্চ মাসে হাইকোর্টে রিট করে ব্লাস্ট। ওই রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করে একমাসের মধ্যে আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিলে বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৫ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের সেই প্রতিবেদন হাইকোর্টে যায় নি বলে জানান ব্লাস্টের চট্টগ্রাম শাখার আইনজীবী দীপক কুমার চৌধুরী।
ট্যাম্পাকো ফায়ার অ্যান্ড কলাপ্স কেস
২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩২ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়। এই ঘটনায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনকে প্রধান আসামি করে ১০ জনকে আসামি করা হয়। এখন পর্যন্ত এই মামলায় অভিযোগপত্র দেয়নি পুলিশ।
ঘটনার পর নিহত ও আহতসহ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতে হাইকোর্টে রিট করা হয়। নিহত ও আহতদের কেন যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে চার সপ্তাহের রুল জারি করে। আইনজীবী ব্যারিস্টার শারমিন আক্তার টিবিএসকে বলেন, রুল জারির পর এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো শুনানি হয়নি। শুনানির জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিচার না পাওয়া আরও ঘটনা
১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মিরপুরের সারেকা গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৫ সালে ঢাকার ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসে অগ্নিকাণ্ডে ১০ জন কর্মী প্রাণ হারান। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সিনটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৭ সালে মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টসে ২৭ জন এবং মিরপুর-১নং মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলসে আগুনে ২২ শ্রমিক মারা যান। ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে আগুনে ৫৩ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ২০০০ সালে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে ১২ শ্রমিক অগ্নিকাণ্ডে মারা যায়। ২০০১ সালে মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুনের গুজবে পদদলিত হয়ে ২৪ শ্রমিক মারা যান। ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে সান নিটিং গার্মেন্টসে আগুনে ২০ শ্রমিক মারা যান। এসব ঘটনায় উল্লেখযোগ্য মামলা নেই।
বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, 'বিভিন্ন সময় যেসব গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের যথেষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়েছে কিন্তু অনেকেই এটি অস্বীকার করেন। যারা চাকরির জন্য এসেছে আমাদের কাছে, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনো যদি কেউ আসে চাকরির জন্য, তাদের জন্য আমাদের দরজা খোলা'।
জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, 'গার্মেন্টসের এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পায়নি। এমনকি ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক দিনের বেতন কেটে ১২২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। সেই অর্থে রানা প্লাজার নামে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে একটি ফান্ড তৈরি করা হয়। মাত্র ২২ কোটি টাকা বিতরণ করা হলেও বাকি ১০০ কোটি টাকা এখনো দেওয়া হয়নি'।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোঃ মুজিবুল হক টিবিএসকে বলেন, 'মামলা নিষ্পত্তির বিষয় সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। আর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে সরকার বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নিয়ে অনেকের টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করেছে'।