অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন নগরের বেকার বস্তিবাসী
অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন রাজধানীর নন্দীপাড়ার একটি বস্তির বাসিন্দা ফিরোজা আক্তার। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে কোনও কাজ নেই ফিরোজার। সরকারি-বেসরকারি কোনো সহায়তা না পেয়ে শারিরীকভাবে অচল স্বামীকে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তার।
স্কুল বন্ধ থাকায় বেকার রয়েছেন রাজধানীর ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল এবং কলেজের ভ্যান চালক আব্দুর রহমান। সরকার থেকে আড়াই হাজার টাকা সহায়তা পাওয়ার আশায় ভোটার আইডি নাম্বারসহ মোবাইল নাম্বার জমা দিয়ে মোবাইল এসএমএসের অপেক্ষায় মাসের পর মাস পার করলেও সরকারি প্রণোদনার টাকা পাননি তিনি।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বস্তিবাসী ও দরিদ্র মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফিরোজা ও রহমানের মতো অবস্থা নগরের অনিয়মিত খাত বা ইনফরমাল সেক্টরে কর্মরত লাখো দরিদ্র মানুষের।
গতবছর থেকে দফায় দফায় কার্যকর করা লকডাউনে জমানো সঞ্চয় আগেই শেষ হয়ে গেছে। ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে ধার করে টিকে থাকার আশাও বিফলে গেছে। চলমান লকডাউনে খাওয়া-পরার খরচ যোগাতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
গত বছর মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণের পর ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিপুল সহায়তা দেওয়া হলেও পরের লকডাউনগুলোতে সে উদ্যোগ সংকোচিত হতে থাকে। গত ২৯ জুন থেকে শুরু হওয়া চলমান লকডাউনে কর্মহীন দরিদ্রদের জন্য সরকারের বিশেষ কোন প্রণোদনা বা খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জেনারেল রিলিফ (জিআর) হিসেবে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কিছু চাল ও নগদ টাকা বিতরণের কর্মসূচি থাকলেও নগর দরিদ্রদের অনেকেই বলছেন, তারা কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শহর ও গ্রামের দরিদ্রদের সহায়তার জন্য আমরা ১ জুলাই থেকে জিআর বিতরণ শুরু করেছি।
এছাড়া, পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে ২৪ কোটি টাকার বেশি নগদ সহায়তা এবং দেড় লাখ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, "দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসরত মানুষ, যারা খাদ্যকষ্টে আছে, তাদের আমরা চাল ও নগদ টাকা সহায়তা দিচ্ছি। একইসঙ্গে যারা সহায়তা নিতে লজ্জা পান, তারা ৩৩৩ নম্বরে কল করলেও সহায়তা পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে, ফোন করে প্রায় দুই লাখের বেশি পরিবার সহায়তা পেয়েছে।"
ঈদের আগে আরও ২৩ হাজার টন চাল ও ১০০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
এসব খাদ্য ও নগদ সহায়তা মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে যায়। সেখান থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়। শহর এলাকায় মন্ত্রণালয় থেকে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা হয়ে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে।
রাজধানীর শাহজাহানপুরের গাজীর বস্তির বাসিন্দা মো. আশিক ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করতেন। কাজ হারিয়ে তিনি এখন রিকশা চালান।
"একসময় প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করতাম। লকডাউনের শুরু থেকে কোন কাজ ছিল না আমার। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে একদিন না খেয়েও থাকতে হয়েছে। তাই ভাড়ায় একটি রিকশা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি, আয় করি ২৫০ টাকা"- জানান তিনি।
গাজীর বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, গেটের সামনেই ১০-১২ জন লোক বসে আছে। সবারই শুকনো ও অসহায় মুখ। কথা হয় তাদের সাথে। জানা যায়, এখানে ১২০ টি ঘরে ৫০০ জনের বেশি মানুষ থাকেন। জীবিকার তাগিদে তাদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন।
তাদের একজন সেলিম। তিনি আগে বাবুর্চির কাজ করলেও এখন তিনি বস্তির সামনে সিগারেট এবং ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করেন।
"এখন খুব একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে না। তাই রান্নার কাজও কমে গেছে। বাধ্য হয়ে চা-সিগারেট বেচি। এতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয়। যা দিয়ে ৬ জনের সংসার অনাহার ও অর্ধাহারে কষ্টে দিন পার করছি", বলেন সেলিম।
আব্দুর রহমান আগে ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলের ভ্যান চালাতেন। ৮ হাজার টাকা বেতন ছিল তার। স্কুল বন্ধ থাকায় বেতনও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শাজাহানপুরে ফুচকা বিক্রি করে ১০০ থেকে ২০০ টাকা আয় করে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে কোনোরকমে চলছেন।
গতবার কিছু চাল ও ডাল দেয়া হলেও এবছর আমাদের এখানে কোনও সহযোগিতা আসেনি, বলেন রহমান।
"সাহায্যের কথা বলে ইতোমধ্যে কয়েকবার আমাদের কাছ থেকে ভোটার আইডি কার্ডের কপি নিয়েছেন সরকারের লোকজন। কিন্তু কোনো সহযোগিতা করেনি"- উত্তেজিত হয়ে বলেন মোহাম্মদ বিজয়। তিনি একসময় দোকানের বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে বেকার।
তার সাথে বেশ কিছু লোকজন উচ্চসরে বলতে থাকেন, গতবার আড়াই টাকা করে মোবাইলে দেয়ার কথা থাকলেও তারা তা পাননি।
"বলেছে মোবাইলে চলে যাবে। কিন্তু আসেনি," বলেন তারা।
শাজাহানপুরের একজন ভ্যানচালক জুলহাস উদ্দিন বলেন, "লকডাউন এর প্রথম দিন থেকে আমাদের কোনো আয় নাই। মার্কেটগুলো বন্ধ থাকায়, এখানকার ৪০ থেকে ৫০ জন ভ্যানচালকের একই অবস্থা।"
"ধারদেনা করে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে আমাদের। সরকারি বা ব্যক্তিগত কোনো সহযোগিতা আমরা পাইনি। খুব কষ্টে আছি। লকডাউন চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে", তিনি যোগ করেন।
তবে খিলগাঁও, মালিবাগ, বাসাবো, মগবাজারসহ বেশ কিছু রিকশাচালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এর চেয়ে কিছুটা ভাল অবস্থায় আছেন তারা।
দক্ষিণ নন্দীপাড়ার রিকশাচালক মোহাম্মদ নজরুল বলেন, "রিকশাচালকদের আয় কিছুটা কমলেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। আগে আমার আয় ছিল ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা, আরে এখন হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।"
একই কথা উল্লেখ করে, খিলগাঁওয়ের রিকশা চালক মোহাম্মদ সামাদ বলেন, "কিন্তু দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে এই আয় দিয়েও পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হয়। আর আমাদের কাছে কোন সাহায্য আসে না।"