ভ্যাকসিন সংকটে আর্মেনিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন ইরানিরা
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের জনসাধারণের মধ্যে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন নেওয়ার তাড়া দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দ্রুত সংক্রামক, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় ইতোমধ্যেই রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ইরানের হাসপাতালগুলো। কিন্তু কোভিড প্রতিরোধে দেশটির সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ। যথাযথ সুরক্ষা না পাওয়ায় বহু ইরানি নাগরিক এবার নিজেরাই নিজেদের জীবনরক্ষার যুদ্ধে নেমেছেন। দলে দলে ইরানের নাগরিকরা প্রতিবেশী দেশ আর্মেনিয়ায় যাওয়া শুরু করেছেন।
সাবেক এই সোভিয়েত ককেশাস দেশটিতে ভ্যাকসিন গ্রহণে অনাগ্রহ চলার মধ্য দিয়েই ঢিমেতালে টিকাদান কর্মসূচি লক্ষ্য করা গেছে। ফলে কর্তৃপক্ষ বিদেশি পর্যটকদের ভ্যাকসিন ডোজ দিচ্ছেন যা ইরানিদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তেহরানের একটি বাস স্টপে ২৩ বছর বয়সী স্বর্ণকার আহমেদ রাজা বাঘেরি নিজের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, "আমি যত দ্রুত সম্ভব তাকে টিকা দেওয়াতে চাই।" ২০ ঘন্টার দীর্ঘ ভ্রমণের পর তিনি মায়ের সাথে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে গিয়ে পৌঁছেছেন।
বাঘেরির চাচা ইতোমধ্যেই টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন আর্মেনিয়ায় এবং খুব শিগগির দ্বিতীয় ডোজও পাবেন। বাস ও প্লেনে করে ইরানিদের সদলবলে আর্মেনিয়া চলে যাওয়ার ঘটনা উঠে এসেছে ইরানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
আর্মেনিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান জানান, তার দেশে টিকা নেয়া এক লাখ ১০ হাজার জনের মধ্যে অর্ধেকই বিদেশী নাগরিক। এই মুহূর্তে আর্মেনিয়া অ্যাস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ান স্পুটনিক ভি এবং চীনা করোনাভ্যাক ভ্যাকসিন প্রদান করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর শিকার হয়েছে ইরান। দেশটির মোট ৮৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম মানুষ পূর্ণাঙ্গ ভ্যাকসিন ডোজ পেয়েছেন।
নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা ইরান রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে কিছু ভ্যাকসিন আমদানি করেছে। বৈশ্বিক কোভ্যাক্স প্রোগ্রামেও যুক্ত আছে তারা। নিজেরা দেশে তিনটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করলেও, সব মিলিয়ে নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারছে না ইরান। স্বাস্থ্যসেবার বাইরে এবং ষাটের কম বয়সী মানুষদের তারা এখনও ভ্যাকসিন দিতে পারেনি। ইরান সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে তারা গণ টিকাদান কর্মসূচি শুরু করবে।
কিন্তু ইরানিদের অনেকেই ভ্যাকসিন পেতে এতদিন অপেক্ষা করতে রাজি নন। তেহরানে ৩৯ বছর বয়সী গার্মেন্ট কর্মী আলী সাঈদি জানালেন, কর্তৃপক্ষ এর আগেও একাধিকবার তাদের গণ টিকাদান কর্মসূচির সময় পিছিয়েছে; তাই তিনি যেভাবেই হোক আর্মেনিয়া গিয়েই টিকা নিবেন।
অন্যদিকে, ২৭ বছর বয়সী সচিব বাহারেহ খানাইয়ের মতে, ইরানি কর্তৃপক্ষ টিকা দিতে যে কঠিন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; তা সহজ করতেই এই ভ্রমণ করছেন ইরানিরা। তিনি একে দেশের উপকার হিসেবেই দেখছেন।
এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন ইরানি নাগরিক ভ্যাকসিন নিতে আর্মেনিয়া গিয়েছেন, তা সঠিক জানা যায়নি। তবে প্রতিদিন ডজন ডজন বাস, ট্যাক্সি ও ফ্লাইটে করে প্রায় ৫০০ জন সীমান্ত পার হচ্ছেন। এয়ারলাইগুলো ইরান থেকে ইয়েরেভানে সপ্তাহে তিনটি করে ফ্লাইট রেখেছে, বাসভাড়াও হয়েছে দ্বিগুণ। করোনায় যেসব ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, হুট করে তাদেরও চলছে রমরমা ব্যবসা।
অন্যদিকে, ইরানিদের চাপে পড়ে আর্মেনিয়ার করোনাভাইরাস পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে প্রচণ্ড ভিড় সৃষ্টি হয়েছে। ইরানি আধাসরকারি সংবাদ সংস্থা 'ইলিনা' জানিয়েছে, প্রচন্ড গরমে সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন বহু মানুষ।
ইয়েরেভান থেকে ১০০ মাইল দূরে শত শত ইরানি ভ্যাকসিনের জন্য লাইন দিয়েছেন এবং কেউ কেউ রাস্তায় শুয়েও জায়গা দখল করেছেন।
আর্মেনীয় রাজধানীতে ভ্যাকসিন পাওয়ার পর আনন্দিত ইরানিদের রাস্তায় নেমে ফারসি গানের তালে নাচতে ও আনন্দ করতে দেখা গেছে।
আর্মেনীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আনাহিত আভানেসিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, "আমরা ভাবতেও পারিনি যে আমাদের এই মানবসেবামূলক কার্যক্রম এতটা জনপ্রিয় হবে এবং এত এত বিদেশি এখানে ভ্যাকসিন নিতে আসবেন। আমাদের নাগরিকরা অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে; কিন্তু আমি আবারও বলছি, মহামারি কোনো নাগরিকত্ব মানে না।"
তবে টিকাদানমূলক পর্যটনকে আর্মেনীয় কর্তৃপক্ষ সাদরে গ্রহণ করলেও, ইরানি পর্যটকদের চাপের কারণে তারা বিভিন্ন বিধিনিষেধ জোরদার করতে বাধ্য হয়েছে।
গত সপ্তাহে আর্মেনিয়া জানিয়েছে যে, একজন বিদেশি নাগরিক ইয়েরেভানের ৫ টি অ্যাস্ট্রাজেনেকা মোবাইল ক্লিনিক থেকে শুধু এক ডোজ নিতে পারবেন। সেই সাথে দেশের পর্যটন খাতকে শক্তিশালী করতে বিদেশি নাগরিককে টিকা নেয়ার আগে অন্তত ১০ দিন আর্মেনিয়ায় থাকতে হবে।
কিন্তু আর্মেনিয়া ভ্রমণে আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ায় বেড়ে গেছে যাতায়াত খরচ। ফলে, এখন আর সকল শ্রেণীর ইরানি নাগরিক সেখানে যেতে পারছেন না, বরং অপেক্ষাকৃত ধনীরাই যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে এখানে এক ধরনের শ্রেণীবৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র: আরব নিউজ