সাভার ট্যানারি শিল্প নগরী: শেষ হয়েও ১৯ বছরে থেকে গেছে অসম্পূর্ণ
সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প গত ৩০ জুন সমাপ্ত ঘোষণা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। পরিবেশ দূষণ রোধ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত কমপ্লায়েন্স চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার।
ছয় গুণ ব্যয় বাড়িয়ে দুই বছর মেয়াদী প্রকল্পটি ১৯ বছর ধরে বাস্তবায়ন করলেও সাভারের চামড়া শিল্পনগরীকে এখনও 'অসম্পূর্ণ ও পরিবেশ-অবান্ধব' বলে মনে করছেন খোদ ট্যানারি মালিকরাই।
দূষণমুক্ত ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলে দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর রপ্তানিমুখী খাতটিতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা কিংবা রপ্তানি বৃদ্ধির মতো কোনই স্বপ্নই পূরণ হচ্ছে না। বরং চার বছর আগে ট্যানারিগুলো হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের পর দ্রুত কমছে রপ্তানি আয়।
সমাপ্ত ঘোষণার আগে দুই বছর মেয়াদের এই প্রকল্পটিই ছিল বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সবচেয়ে পুরনো প্রকল্প।
২০০৩ সালে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ ১২ দফা বাড়ানোর পাশাপাশি ১৭৫ কোটি টাকার পরিবর্তে ১০১৫ কোটি খরচ করা হলেও পরিবেশ দূষণ বন্ধে কমন ক্রোম রিকভারি ইউনিট নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি।
এছাড়া, সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে রিসোর্স জেনারেশনের ব্যবস্থাও রাখা হয়নি বলে মনে করছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন।
প্রকল্পের আওতায় দুই বছরের মধ্যে সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) স্থাপন করার কথা থাকলেও চীনা ঠিকাদারী কোম্পানির খামখেয়ালিপনা ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কারণে তা শেষ হতে লেগেছে সাত বছরেরও বেশি সময়।
কিন্তু সেই সিইটিপির পরিশোধন ক্ষমতা পিক সিজনে ট্যানারিগুলোর উৎপাদিত বর্জ্যের মাত্র অর্ধেক। তাই সিইটিপিতে বর্জ্য পুরোপুরি ট্রিটমেন্ট হওয়ার আগেই তা ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আর ট্যানারির কঠিন বর্জ্য পরিশোধনের কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
আগে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো যেভাবে বুড়িগঙ্গার পানিকে বিষে পরিণত করছিল, সেই ভাগ্য বরণ করতে হচ্ছে এককালের টলমলে স্বচ্ছ পানির ধলেশ্বরীকে। অথচ ট্যানারি ও চামড়াজাত দ্রব্যের প্রস্তুতকারী শিল্প মালিকদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো কমপ্লায়েন্স।
ইএসকিউ (এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটি), আইএসও এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা জরুরি হলেও তা সম্ভব হয়নি।
২০১৬-১৭ সালকে সরকারিভাবে 'চামড়া বর্ষ' ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চামড়া শিল্পের পতন সেই সময় থেকেই শুরু হয়। শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করে এ খাতের উন্নয়নে নিয়মিত সভা করার কথা ছিল, তাও হয়নি।
ফলে দেশে উন্নতমানের চামড়া থাকা সত্ত্বেও প্রক্রিয়াকরণ ও পণ্য উৎপাদনে পরিবেশসম্মত কমপ্লায়েন্স না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি সাত বছর ধরে কমছে।
লেবার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদের অভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের পর রপ্তানির পরিমাণ আরও কমতে থাকে। পরের বছর রপ্তানি আয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান হারিয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে চামড়া খাত।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এখন বলছে, একটি পরিপূর্ণ চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য যেসব বিষয় দরকার ছিল, তা প্রকল্পে সংযুক্ত ছিল না। কঠিন বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা করতে যে চীনা কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়েছিল, তারা তা করেনি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চামড়া শিল্পনগরীর অবকাঠামো উন্নয়ন শেষ। ফায়ার স্টেশন, পুলিশ ফাঁড়ি ও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলছে ২৫ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন সক্ষমতার সিইটিপিও।
কিন্তু, কোরবানি ঈদের পর অনেক বেশি চামড়া প্রক্রিয়াকরণের সময় বর্জ্য উৎপাদন হয় প্রায় ৫০ হাজার ঘনমিটার। বছরের বাকি সময় ২৮ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন করে ট্যানারিগুলো। ফলে বর্জ্যের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় পুরোপুরি শোধন করার আগেই তা ফেলে দেওয়া হয় ধলেশ্বরীর পানিতে।
বেহাল দশা কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। চামড়া শিল্পনগরীর পশ্চিমাংশে ধলেশ্বরী নদীর তীরে উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে ট্যানারির কঠিন বর্জ্য বা সলিড ওয়েস্ট, যা পরিবেশের পাশাপাশি দূষণ করছে নদীও। প্রকল্পের সীমানা ভেঙ্গে নদীতে মিশছে উন্মুক্ত পড়ে থাকা চামড়া বর্জ্য।
স্থানীয়দের মতে, বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে পরিকল্পিত, আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী করার কথা থাকলেও তা হয়নি। ফলে ধলেশ্বরীসহ আশপাশের এলাকাতেও গন্ধ ছড়াচ্ছে উন্মুক্ত বর্জ্য।
আরেকটি সিইটিপি স্থাপন, কঠিন বর্জ্য শোধন ব্যবস্থাসহ ব্যবসায়ীদের জন্য আরও প্লট তৈরি করতে বিদ্যমান ট্যানারি পল্লীর পাশে ২০০ একর জমিতে অপর একটি পল্লী স্থাপনের জন্য নতুন করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ডিটেইল প্রজেক্ট প্রোপজাল (ডিপিপি) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
সাভারে ট্যানারি পল্লী স্থাপন প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রকল্প অব্যবস্থাপনার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, "বিসিক এ ধরনের কাজ করার যোগ্যই নয়। তারা হাঁস-মুরগি পালনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। দরকার ছিল ইপিজেড কর্তৃপক্ষের মতো কমপিটেন্ট কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া।"
"চামড়া শিল্প খুবই পরিবেশ সংবেদনশীল শিল্প। সিইটিপি নিয়ে বিসিক যা করেছে, তাতে আরও দশবছর আগেই তাদের কাছ থেকে প্রকল্প সরিয়ে অন্যদের হাতে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকার করেনি। তাদের মাধ্যমেই আবার নতুন প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা করা হলে সেটিও পুরোপরিভাবে ব্যর্থ হবে"- যোগ করেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, "চামড়া শিল্পনগরী করতে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে সরকারের ভুল ছিল। চামড়া শিল্পের সাথে অনেক বিশেষায়িত বিষয় জড়িত, যেগুলো সম্পর্কে বিসিকের কোন ধারণাই নেই। এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব এমন একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে, যার কোনো দক্ষতা নেই।"
"পরবর্তীতে সরকার এ ধরনের কোনো প্রকল্প নিলে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দক্ষ ও যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। তা না করলে এবারের মতোই ভোগান্তি পোহাতে হবে"- জানান তিনি।
শিল্পনগরীটিকে 'অসম্পূর্ণ' ও 'পরিবেশ-অবান্ধব' আখ্যা দিয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ আরও দু'বছর বাড়াতে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)।
সংগঠনটির সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, সর্বজনীন (কমন) ক্রোম রিকভারি ইউনিট পরিপূর্ণভাবে নির্মাণ না হওয়া, সিইটিপি কমিশনিং এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রিসোর্স জেনারেশনের ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে আমরা প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর অনুরোধ করেছি।
চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্র নাথ পাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অতীতে বিভিন্ন কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। তবে এখন সিইটিপি চালু করাসহ প্রকল্পের সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই শিল্প নগরীতে কঠিন বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়গুলো সম্পৃক্ত করে নতুন আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।"
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যবসা হিসাবে এ দেশে চামড়া খাতের যাত্রা শুরু হয় গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। ১৯৪০ সালে ব্যবসায়ী রণদা প্রসাদ সাহা (আরপি সাহা) নারায়ণগঞ্জের কাছে সর্বপ্রথম একটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠা করে এর গোড়াপত্তন করেন।
এর প্রায় এক দশক পর তৎকালীন সরকার ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প স্থাপন করে। স্বাধীনতার পর ওয়েট ব্লু রপ্তানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে খাতটি। ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে ক্রাসড ও ফিনিসড লেদার, জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে চামড়া খাতের রপ্তানিতে পণ্যবৈচিত্র্য আসে।
এই সময় বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিদেশেও পরিচিতি পায় এবং পাট ও পাটপণ্যকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি পণ্য হিসাবে জায়গা করে নেয় চামড়া শিল্প। ২০১৩-১৪ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয় ১ হাজার ২৫৯ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় হয়েছে ৯৪১ মিলিয়ন ডলার।
অব্যবস্থাপনার অনন্য নজির
পরিবেশদূষণ যাতে না হয়, সে জন্য সাভারে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যেমন এসটিপি, সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ডসহ যাবতীয় আধুনিক সুবিধা নির্মাণ করে কমপ্লায়েন্স চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে ২০০৩ সালে প্রকল্প নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিক, যা ২০০৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। শুরুতে ট্যানারি মালিকদের হাজারীবাগ ছেড়ে যাওয়ার অনীহা প্রকল্পে বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটায়।
প্রকল্প দলিলে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তুলে ধরে বলা হয়, একটি আধুনিক সিইটিপি নির্মাণসহ চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের মাধ্যমে হাজারীবাগ ও দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ট্যানারী শিল্পগুলো ওই নগরীতে স্থানান্তর করে পরিবেশ সম্মত উৎপাদনে সহায়তা দেওয়া হবে।
এছাড়া, চামড়া শিল্প উদ্যোক্তাদের অবকাঠামোগত সুবিধাদিসহ অন্যান্য সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে চামড়া শিল্পের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করার কথাও বলা হয়। উন্নত পরিবেশ তৈরীর মাধ্যমে এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগ ও বাজার আকৃষ্ট করার মধ্য দিয়ে উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। এর ফলে এখাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, জাতীয় অর্থনীতিতে চামড়া শিল্পের অবদান বাড়বে।
শুরুতে কথা ছিল শিল্পনগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ট্যানারিগুলো নিজেরাই ইটিপি স্থাপন করবে। কিন্তু ট্যানারিগুলো তা করছিল না। পরে অনেক দেন-দরবারের পর শিল্প মন্ত্রণালয় প্রকল্পের আওতায় সিইটিপি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১০ সালে প্রকল্প সংশোধন করে। তখন প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ৫৪৫ কোটি টাকা।
সিইটিপি ও ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণসহ আরও কিছু টেকনিক্যাল কাজ পায় একটি চীনা প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালের মার্চে কোম্পানিকে ২৪ মাস সময় দিয়ে কার্যদেশ দেওয়া হয়। পরের বছর সিইটিপিকে আরও যুগোপযোগী করার জন্য সংশোধনীর মাধ্যমে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, স্লুয়েজ পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম এবং সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যুক্ত করে ট্যানারি মালিকদের ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণসহ মোট প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সিইটিপি নির্মাণ কাজের সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ের জন্য বুয়েটের বিআরটিসিকে নিযুক্ত করা হয়। প্রকল্পের চতুর্থ সংশোধনীতে এসপিজিএস কম্পোনেন্টটি বাদ দিয়ে প্রাক্কলিত ব্যয় ১ হাজার ১৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা এবং সময় জুন ২০২১ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
কিন্তু নিয়োজিত চীনা ঠিকাদার কোম্পানিটি সময়মতো কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। নানা অজুহাতে এ কোম্পানি সময় বাড়াতে থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষও কোম্পানিটির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে।
এরই মধ্যে শিল্পনগরীর কোন সুবিধাই নিশ্চিত না করে ট্যানারিগুলোকে বারবার স্থানান্তরের সময়সীমা বেঁধে দিতে থাকে শিল্প মন্ত্রণালয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় উচ্চ আদালত হাজারীবাগের কারখানাগুলোর গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দেওয়ার পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে কারখানাগুলো একযাগে স্থানান্তরিত হয়।
সিইটিপির বিভিন্ন কম্পোনেন্টের কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ১৩০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন শুরু করে। আগে হাজারীবাগের বর্জ্য ও দূষিত কেমিক্যালস বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে মিশ্রিত হতো, এখন সাভারের ট্যানারি এস্টেটের দূষণ ধলেশ্বরী নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে। এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর ট্যানারি শিল্পনগর কর্তৃপক্ষকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করতে থাকে। অবশেষে সিইটিপি চালু হলেও তার সক্ষমতা কম থাকায় পরিবেশ দূষণ চলছেই।
জমির লিজ দলিল সম্পন্ন হয়নি এতদিনেও
হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তর হওয়া ট্যানারিগুলো সাভারে নিজস্ব প্লট পেলেও জমির দাম পরিশোধ করেনি। মাত্র চার থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্লটের পুরো মূল্য পরিশোধ করে লিজ দলিল করেছে। বাকিরা দুই-একটি কিস্তি দিলেও বাকি টাকা দেয়নি। ফলে তাদের লিজ দলিল হয়নি।
সুদমুক্তভাবে জমির মূল্য পরিশোধের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ পর্যন্ত সময় দিয়েছিল বিসিক। এখন প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ায় জমির মূল্যের সঙ্গে বাড়তি সুদও গুনতে হবে ট্যানারি মালিকদের।
এখাতের অনেক উদ্যোক্তাই আগে থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপি। সে কারণে তারা নতুন ঋণ সংগ্রহ করতে পারেননি। লিজ দলিল না হওয়ায় প্লটের জমি বন্ধকও রাখতে পারছেন না তারা।
ট্যানারি মালিকরা বলছেন, প্রকল্প এলাকায় কারখানা ভবন নির্মাণ, নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি, পুরনো যন্ত্রপাতি স্থানান্তর ইত্যাদি কাজে উদ্যোক্তাদের বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকা, আয় না থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, বিদ্যমান ঋণের কিস্তি বা সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার কারণে অনেক উদ্যোক্তা আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়েছেন।
এদিকে, হাজারীবাগের পরিত্যক্ত জমি রাজউক 'রেড জোন' হিসাবে ঘোষণা করেছে। সেজন্য ট্যানারি মালিকরা তাদের জমি বা স্থাপনা বিক্রয় কিংবা বিকল্প কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না।
ট্যানারি মালিকরা প্লটের মূল্য বাবদ সরকারকে কতো টাকা জমা দিয়েছে এবং কতো টাকা বাকি রয়েছে, সে তথ্য জানাতে পারেনি বিসিক কিংবা বিটিএ কর্মকর্তারা।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, "ট্যানারি স্থানান্তরের সময় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোভিডের কারণেও ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হয়েছে। আবার, জমি ডিডের ক্ষেত্রেও রয়েছে অস্পষ্টতা। সব মিলিয়ে মালিকদের পক্ষে টাকা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।"