ধামাকার শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা চায় সিআইডি
ইভ্যালির পর আলোচিত আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিংয়ের লেনদেনে ব্যাপক অসামঞ্জস্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, সাউথ-ইস্ট ব্যাংকের যে অ্যাকাউন্টে ধামাকার অর্থ লেনদেন হয়েছে; সেটি খোলা হয়েছে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের নামে। ওই অ্যাকাউন্টটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মোট ৫৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। আর সর্বশেষ ২৭ জুনের তথ্যানুযায়ী এ অ্যাকাউন্টে রয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার ৭৩১ টাকা।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ন কবির টিবিএসকে বলেন, "ধামাকার লেনদেনে অসামঞ্জস্য পাওয়া গেছে । অন্য প্রতিষ্ঠানে ধামাকার টাকা বিনিয়োগের বিষয়টিও আমরা তদন্ত করছি। তবে ধামাকার সংশ্লিষ্টদের কাছে ই-কমার্স ব্যবসা করার কোন অনুমতি বা রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা- জানতে চাইলে তারা কোন কাগজ দেখাতে পারেনি।"
এর আগে আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির লেনদেনও ব্যাপক অসামঞ্জস্য পাওয়া যায়। গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায় যে, ইভ্যালির মোট দায় ৪০৭.১৮ কোটি টাকা। গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ ২১৩.৯৪ কোটি টাকা এবং মার্চেন্টদের নিকট হতে ১৮৯.৮৫ কোটি টাকার মালামাল বাকিতে গ্রহণের পর; স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিষ্ঠানটির কাছে কমপক্ষে ৪০৩.৮০ কোটি টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা থাকলেও, রয়েছে মাত্র ৬৫.১৭ কোটি টাকা।
সিআইডির প্রাথমিক তদন্তে গ্রাহকের বিপুল অংকের টাকা বিদেশে টাকা পাচার, ভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ ও কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা যোগসাজশ করে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে- ধাকামার ডিএমডি নাজিম উদ্দিন আফিস, ডিরেক্টর অপারেশন সাফওয়ান আহমেদ, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগের প্রধান আমিনুর হোসেন ও সিইও সিরাজুল ইসলামসহ পাঁচ জনের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্লক করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সিআইডি এসবি ইমিগ্রেশন ও নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আজ সোমবার (১৯ জুলাই) চিঠি পাঠান।
এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ রাসেলের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) বিশেষ পুলিশে সুপার (এডমিন) শাহরিয়ার কবির টিবিএসকে বলেন, প্রতিদিন বিভিন্ন সংস্থা থেকে এ ধরনের চিঠি পাই। চিঠির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিয়েছি। সিআইডি থেকে আজ এ সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছি। তবে সেটা ধামাকার লোকজনের বিষয়ে কিনা- সেটা এখনও দেখিনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ধামাকা শপিং নামে কোন কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন নেই। নেই তাদের নিজস্ব কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর। প্রতিষ্ঠানটি চলছিল ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। ধামাকা রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করলেও এখনও পায়নি। এভাবে রেজিস্ট্রেশন না নিয়েই কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ধামাকা।
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ধামাকা শপিং থেকে প্রতিষ্ঠানের অর্থ প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ নিজ নামে এবং ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে আত্নসাৎ করেছেন।
কর্মকর্তারা আরও বলছেন, গত দুইদিন ধামাকার সিইও সিরাজুল ইসলাম ও প্রধান একাউন্স ও ফিন্যান্স অফিসার আমিনুর হোসেনকে সিআইডি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির এমডি জসিম উদ্দিন চিশতিকে চিঠি দিয়ে সিআইডি অফিসে ডাকা হলেও তিনি তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেননি।
তদন্ত সংশিষ্ট এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ধামাকার তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি এমডি ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা অবৈধ চ্যানেলে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন। ধামাকার গ্রাহকদের প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন গাজীপুর মাইক্রো ফুড বেভারিজ নামের একটি ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে। এছাড়াও, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা মোটা অংকের টাকা নিজেদের ব্যাংক একাউন্টে সরিয়ে ফেলেছেন।
সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে লেনদেনে ব্যাপক অসামঞ্জস্যতার বিষয়ে একজন আরেকজনের উপর দায় চাপিয়েছেন। তবে ধামাকার টাকা সরিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও পাচারের কথা স্বীকার করেছে তারা।
লেনদেনের অসামঞ্জস্যতা প্রসঙ্গে জানতে ধামাকাশপিং ডটকমের প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম রানাকে সোমবার ফোন দিলে তিনি টিবিএসকে বলেন, এই বিষয়টি তিনি জানেন না। এসব বিষয় এমডি ও হিসাব বিভাগের প্রধান জানেন। এর আগে ধামাকার টাকা পাচারের বিষয়ে একই বক্তব্য দেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানের এমডি এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমেরিকায় আছেন। করোনার কারণে দেশে আসতে পারছেন না।
এদিকে, ধামাকায় অর্ডার দিয়ে নির্দিষ্ট কর্মদিবস শেষে পণ্য না পাওয়া গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলেছে টিবিএস। গ্রাহকদের একজন পাবনার সালাহ উদ্দিন। তিনি বলেন, "৩ মাস আগে ৪০% ছাড়ে ধামাকায় ৫টি বাইক অর্ডার দিয়েছিলাম। চলতি মাসের পণ্য পাওয়ার কথা ছিল। মার্চ মাসের আগপর্যন্ত ধামাকা যথাসময়ে পণ্য দিয়েছে। কিন্তু, মার্চের পর থেকে আর পণ্য পাচ্ছি না। চেক দিয়েছে সেগুলোর টাকা ক্যাশ করতে ব্যাংকে গিয়ে শুনি অ্যাকাউন্টে টাকা নেই।"
"এসব সমস্যা সমাধান জানতে ধামাকার অফিসে যোগাোযাগ করা হলেও প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা কোন সমাধান দিচ্ছেন না," অভিযোগ করেন তিনি।
গত বছরের নভেম্বর মাসে যাত্রা শুরু করে ধামাকা। ইভ্যালির মতো গাড়ি, বাইকসহ বিভিন্ন পণ্য ধামাকা ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত অফার দিয়ে গ্রাহকদের থেকে মোটা অংকের টাকা অগ্রিম হিসেবে তুলে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি মার্সিডিজ বেঞ্জসহ নামিদামি বিভিন্ন ব্যান্ডের গাড়িতেও ৩৫ শতাংশ ছাড়ের অফার দিয়েছিল।
এদিকে সোমবার প্রতিষ্ঠানটির ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন পণ্য ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে গ্রাহকদের থেকে অর্ডার নিচ্ছে। তবে বাইক ও গাড়িতে অফার কমিয়ে এখন ১০ শতাংশ করেছে। প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দে বাংলাদেশ ব্যাংকে সিআইডির চিঠি পাঠানোর সংবাদের প্রকাশের গত দুইদিনে পর অর্ডার অনেক কমে গেছে।
অন্যদিকে, নানা অনিয়মের অভিযোগে ভিত্তিতে ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদীনের প্রদীপ, কিউকুম, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস- এর সঙ্গে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বন্ধ করেছে ব্যাংক, এশিয়া ও ঢাকা ব্যাংকসহ বেশকিছু ব্যাংক।
সর্বশেষ আলোচিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালিসহ ১০ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফোন ভিত্তিক আর্থিক (এমএফএস) সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান- বিকাশ।