আধুনিক ওমানের রূপকার সুলতান কাবুস
ওমানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক প্রয়াত সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদ। তাকে আধুনিক আরব বিশ্বের রূপকারও বলা হয়ে থাকে। আরবের এই উপদ্বীপটিকে একটি পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। নিজের সালতানাতকে তিনি যেমন আঞ্চলিক উত্তেজনা থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, তেমনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও তার চাহিদা ছিল।
১৯৪০ সালের ১৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন কাবুস। দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রাদেশিক রাজধানী সালালাহে কয়েক বছরের পুরনো আল-সাঈদ রাজপরিবারে তার জন্ম।
পড়াশোনার জন্য ব্রিটেনে পাঠানো হয় তরুণ কাবুসকে। স্যান্ডহার্স্ট রয়েল সামরিক অ্যাকাডেমি থেকে ১৯৬২ সালে স্নাতক ডিগ্রি নেন তিনি।
পরে ব্রিটিশ পদাতিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে জার্মানিতে চলে যান। তার বাবা সুলতান সাঈদ বিন তাইমুরের কড়া নজরদারি থেকে বাঁচতে অনুকূল সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন কাবুস।
ক্ষমতা দখল
সুলতান সাঈদ বিন তাইমুর ছিলেন ভীষণ রক্ষণশীল। তার শাসনামলে ওমান ছিল একটি পশ্চাদপদ রাজ্য। তিনি ওমানে অনেকে বিষয় নিষিদ্ধ করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল- বিদ্যুৎ ব্যবহার, রেডিও শোনা, সানগ্লাস পরা ইত্যাদি। এমনকি ছাতার ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন তাইমুর।
ওমানে কে বিয়ে করতে পারবে, কে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, এমনকি কে দেশত্যাগ করবে - এসব কিছুর সিদ্ধান্ত তিনি দিতেন। তখন ওমানে মাত্র ১০ কিলোমিটার পাকা সড়ক এবং তিনটি স্কুল ছিল। দাসপ্রথা ছিল বৈধ।
১৯৭০ সালে ২৯ বছর বয়সে ব্রিটিশদের সহায়তা নিয়ে পিতাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদ। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর সংস্কারযজ্ঞ শুরু করে ওমানকে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।
নতুন ওমানের বিকাশ
পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সুলতান কাবুস ওমানে আধুনিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন। তৈরি করেন স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল।
দেশটির তেল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ওমানের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি। তার শাসনামলে ওমান একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
শুধু তাই নয়, সুলতান কাবুসের আমলেই ওমানের প্রথম লিখিত সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রের মৌলিক বিধি উপস্থাপন করেন ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ। এটিই হলো ওমানের প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধান ইসলামী আইন ও প্রচলিত আইনের কাঠামোয় বিভিন্ন অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এর মাধ্যমে মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে কোনো সরকারি শেয়ার হোল্ডিং সংস্থার কর্মকর্তা হওয়া যাবে না।
২০১০ সালের হিসাব বলছে, ওমানের গড় আয়ু ৭৬ বছর। প্রতি এক হাজার লোকের জন্য ২.১ জন ডাক্তার ও ২.১টি হাসপাতালের শয্যা রয়েছে।
ওমানে অনেক বিদেশি কাজ করেন। এখানকার ৩৫ লাখের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ লোক ওমানি নাগরিক নন, মূলত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইরান থেকে আসা বিদেশি কর্মী। প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ২০১০ সালে ছিল ৮৬.৯%।
নারী নীতি
নারীদের পশ্চাদপসরতাকে সমর্থন করতেন না সুলতান কাবুস। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওমানের মজলিশ আল শূরার জন্য প্রায় ১ লাখ ওমানি নারী ও পুরুষ মিলে দুজন নারীসহ মোট ৮৩ জন প্রার্থী নির্বাচিত করেন। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে সুলতান কাবুস ৪৮ জনকে মজলিশ আল দাউলায় নিযুক্ত করেন। এটা তাদের দেশের রাষ্ট্রীয় পরিষদ। এই পরিষদে পাঁচজন নারী সদস্যও ছিলেন।
ওমানের নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা ও পড়াশোনা করতে পারেন। মজার বিষয় হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষ ছাত্রদের জন্য কোটা রাখা রয়েছে। কেননা স্কুল-কলেজে মেয়েরাই সাধারণত ভালো ফলাফল করে থাকে। ফলে ছেলেরাই উল্টো পিছিয়ে পড়ছে।
কর্মক্ষেত্রেও ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই একসঙ্গে কাজ করে আসছে।
পররাষ্ট্রনীতি
সুলতান কাবুসকে মনে করা হতো একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ওমানের সুলতানের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হলো মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
প্রতিপক্ষ দেশ ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতেন।
২০১৩ সালে ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পর্দার আড়ালে আলোচনার সূত্রপাত করাতে ভূমিকা রাখেন সুলতান কাবুস। সে ধারাবাহিকতায় ঐতিহাসিক পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি হয়েছিল।
হরমুজ প্রণালির ওপর ওমানের কৌশলগত অবস্থান নিয়ে নেন ওমানের সুলতান। প্রনালিটি পারস্য উপসাগরের প্রবেশপথে প্রায় ৩৫ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে ওমান সর্বদা সচেতন থাকে। ইরাকের সঙ্গে ওমানের সুলতান একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন যখন তারা একই সঙ্গে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ জোটকেও সমর্থন দিচ্ছিলেন। ওমান ওই জোটে সৈন্য পাঠিয়েছিল এবং তাদের দেশকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের জন্য উন্মুক্ত রেখেছিল।
একচ্ছত্র শাসন
গত প্রায় পাঁচ দশক যাবত সুলতান কাবুস ওমানের রাজনীতি একচ্ছত্র ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ওমানের জনসংখ্যা প্রায় ৪৬ লাখ, যার মধ্যে ৪৩ শতাংশ বিদেশী নাগরিক।
ওমানে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে সুলতানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে। ওমানের সুলতান একাধারে দেশটির প্রধানমন্ত্রী,সামরিক বাহিনী সর্বাধিনায়ক, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সুলতান কাবুস ওমানের জনগণের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন এবং তার হাতেই ছিল সম্পূর্ণ রাজতন্ত্র। যে কোন বিরোধী মতকে তিনি কঠোরভাবে দমন করতেন।
তিনি ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সাহায্য নিয়ে ওমানের দক্ষিণাঞ্চলে উপজাতিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমন করেন।
এরপর ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় ওমানেও কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দেশটিতে বড় ধরণের কোন বিক্ষোভ হয়নি। কিন্তু ওমানের বিভিন্ন জায়গায় হাজার-হাজার মানুষ ভালো মজুরির দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন।
তাদের দাবির মধ্যে আরো ছিল অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতি বন্ধ করা।
'বেআইনি সমাবেশ' এবং 'সুলতানকে অপমান' করার অভিযোগে শতশত মানুষকে তখন বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।
সুলতান কাবুস পরবর্তীতে দুর্নীতিবাজ শাসক হিসেবে পরিচিত হন। এসময় দীর্ঘ সময় ধরে মন্ত্রিত্বে থাকা কিছু ব্যক্তিকে সরিয়ে দেন তিনি। তিনি সরকারি চাকরির সুযোগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও দেন।
তখন সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোকে বন্ধ করে দেন তিনি। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, তখন বিভিন্ন বই বাজেয়াপ্ত এবং মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানিও করা হয়।
সুলতান কাবুসের কোনো উত্তরাধিকারী নেই। তার উত্তরাধীকারী হিসেবে তিনি কাউকে নির্বাচনও করেননি। চিকিৎসার জন্য গত সপ্তাহে তিনি বেলজিয়াম গিয়েছিলেন। তখন খবর বেরিয়েছিল যে তিনি অন্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত।
গত ১০ জানুয়ারি ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদ।
তার মৃত্যুর পর সুলতান হিসেবে কাবুস বিন সাঈদের চাচাতো ভাই হাইথাম বিন তারিক আল-সাঈদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।