বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সুনামি
১৯৫৮ সালের ৯ জুলাইয়ের রাত। প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল আলাস্কার লিটুয়া বে-র উত্তরপূর্ব তীরে অবস্থিত ফেয়ারওয়েদার ফল্ট। সেই ভূকম্পনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে ফেয়ারওয়েদার ফল্ট থেকে ৩ কোটি ঘনমিটার পাথর ধসে পড়ে লিটুয়া বে-র গিলবার্ট ইনলেট নামক সঙ্কীর্ণ খাঁড়িতে। ৩ হাজার ফুট উঁচু থেকে ধসে পড়েছিল পাথরগুলো। এই পাথরধসের ফলে সৃষ্টি হয় সুনামি।
সেদিনের ভূমিকম্প এতই শক্তিশালী ছিল যে গোটা লিটুয়া বে কেঁপে ওঠে তাতে। সুনামির ঢেউ ১৭২০ ফুট উঁচুতে থাকা সমস্ত গাছপালা শেকড়সহ উপড়ে নিয়ে আসে। লাখ লাখ গাছ উপড়ে এসে সেই সুনামির সঙ্গে ভেসে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটিই বৃহত্তম সুনামি।
আলাস্কা উপসাগরের উত্তরপূর্ব তীরে অবস্থিত খাঁড়ির নাম লিটুয়া বে। খাঁড়িটি সাত মাইল লম্বা ও দু-মাইল চওড়া। এর সর্বোচ্চ গভীরতা ৭২০ ফুট।
ফেয়ারওয়েদার ফল্ট লিটুয়া বে-র উত্তরপূর্ব প্রান্ত ধরে চলে গেছে। এর ফলে ইংরেজি 'টি' অক্ষরের আকার পেয়েছে লিটুয়া বে।
১৯৫৮ সালের ৯ জুলাইয়ের পাথরধস হয় গিলবার্ট ইনলেটের উত্তরপূর্ব তীরে। পাথর পড়েছিল প্রায় তিন হাজার ফুট ওপর থেকে। খাঁড়ির পানিতে তিন কোটির বেশি ঘনমিটার পাথর ধসে পড়ার ফলে সুনামির উৎপত্তি হয়। সেই সুনামির ধাক্কায় লিটুয়া বে-র দুই তীরের সমস্ত গাছপালা উপড়ে যায়।
লিটুয়া বে সুনামির কারণ:
১. ফেয়ারওয়েদার ফল্টে ভূমিকম্প। ফলে গিলবার্ট ইনলেটের পূর্ব তীর থেকে প্রায় ৩০.৬ মিলিয়ন ঘনমিটার পাথর ধসে পড়ে।
২. গিলবার্ট ইনলেটে ধসে পড়া ৩০.৬ মিলিয়ন ঘনমিটার পাথরের গতিবেগ ও ভর শক্তিশালী ঢেউয়ের সৃষ্টি করে। সেই ঢেউ বয়ে যায় গোটা খাঁড়িতে।
৩. পাথরধসে সৃষ্ট ঢেউ গিলবার্ট ইনলেটের পশ্চিম দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ১৭২০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়।
৪. সেই ঢেউ গিলবার্ট ইনলেটের পশ্চিম দেয়াল টপকে লিটুয়া বে-তে নেমে আসে। তারপর সেখান থেকে পৌঁছে যায় আলাস্কা উপসাগরে। পথে দুই তীর থেকে সমূলে উপড়ে নিয়ে যায় লাখ লাখ গাছপালা।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে সেদিনের সুনামি:
সেদিন রাত আটটার দিকে সাত বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে লিটুয়া বে-তে প্রবেশ করেছিলেন হাওয়ার্ড জি. উলরিখ। খাঁড়ির ৫ ফ্যাদম গভীরতায় নৌকার নোঙর ফেলেন তারা। রাত একটু গভীর হতেই আচমকা ভয়ানকভাবে দুলে ওঠে উলরিখদের নৌকা। তড়িঘড়ি করে ডেকে গিয়ে উলরিখ দেখতে পান খাঁড়ির মাথা থেকে হুড়মুড় করে পাথর ধসে পড়ছে নিচে।
উলরিখ জানান, ভূমিকম্প শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে গিলবার্ট ইনলেট থেকেই সুনামির উৎপত্তি হয়। প্রথমে বিস্ফোরণ, তারপর সেখান থেকে ঢেউয়ের সৃষ্টি।
সেই ঢেউ উলরিখের নৌকার কাছে পৌঁছতে আড়াই থেকে তিন মিনিট সময় নেয়। উলরিখ চেষ্টা করেও নোঙর তুলতে পারলেন না। তাই পুরো শেকল ছেড়ে দিয়ে (প্রায় চল্লিশ ফ্যাদম) ইঞ্জিন চালু করেন। ঢেউয়ের সঙ্গে ওপরে-নিচে উঠতে থাকে উলরিখের নৌকা। চোখের আন্দাজে উলরিখের মনে হয়েছিল ঢেউয়ের উচ্চতা ৫০ থেকে ৭০ ফুটের মধ্যে ওঠা-নামা করছিল।
প্রমত্ত ঢেউয়ে উত্তাল লিটুয়া বে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর খাঁড়ির পানি ফের স্বাভাবিক উচ্চতায় নেমে আসে। তবে পানি খুব অশান্ত হয়ে ছিল। ঘড়িতে সময় তখন রাত ১১টা।
সুনামির সময় আরও একটা নৌকা ছিল লিটুয়া বে-তে। নৌকাটা নোঙর ফেলা ছিল বে-র প্রবেশমুখে। দানবিক ঢেউয়ে ওটা ডুবে গিয়েছিল। জীবিত কাউকে ওই নৌকায় পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় দুজন মানুষ ছিল নৌকাটিতে।
১৯৫৮ সালের জুলাইয়ের আগে থেকেই ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে-র ডন জে. মিলার লিটুয়া বে-তে বিশাল ঢেউ সৃষ্টি হয় কিনা- জানার জন্য গবেষণা করছিলেন। তার কাছে লিপিবদ্ধ প্রমাণ ছিল অন্তত চারবার লিটুয়া বে-তে বিশাল ঢেউ সৃষ্টি হয়েছে, যথাক্রমে; ১৯৩৬, ১৮৯৯, ১৮৭৪ ও ১৮৫৩ (বা ১৮৫৪) সালে।
আগের ঢেউগুলো বিশাল ছিল; কিন্তু ১৯৫৮-র ঢেউ আগের সবগুলোর রেকর্ড ভেঙে দেয়। ১৯৫৮-র ঢেউ সৃষ্টি হওয়ার সময় মিলার আলাস্কাতেই ছিলেন। ৯ জুলাইয়ের ঢেউ সৃষ্টির পরদিন তিনি লিটুয়া বে-তে যান। সরেজমিনে ধ্বংসলীলার সব দেখে সিদ্ধান্তে আসেন, এবারের ঢেউই লিটুয়া বে থেকে সৃষ্ট সবচেয়ে উঁচু ও বড় ঢেউ ছিল।
অনেকের দাবি, লিটুয়া বে-তে উৎপন্ন সেই ঢেউ সুনামি ছিল না। কিন্তু, ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে তাদের অসংখ্য প্রতিবেদন ও প্রকাশনায় এ ঢেউয়ের ব্যাপারে লেখার সময় 'সুনামি' শব্দটাই ব্যবহার করেছে।
ঘটনাপ্রবাহ থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতি শতাব্দীতেই লিটুয়া বে-তে অন্তত দু-একবার বিশাল সুনামিতুল্য ঢেউয়ের উৎপত্তি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, পরের ঢেউটা সৃষ্টি হবে কবে?
- সূত্র: জিওলজি ডটকম