বাড়ছে প্যাকেটজাত গুঁড়া মশলার চাহিদা
নগরায়নের প্রভাবে মানুষের জীবনে ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। ফলে শিল পাটায় বাটা মশলা দিয়ে রান্নার প্রবণতার মধ্যেও তরতরিয়ে বাড়ছে ব্র্যান্ডেড গুঁড়া মশলার চাহিদা। প্রতিনিয়তই বড় হচ্ছে প্রক্রিয়াজাত মশলার বাজার।
ব্র্যান্ডেড গুঁড়া মশলা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারাদেশে মশলার বাজার ৪৫০০-৫০০০ হাজার কোটি টাকার। যেখানে প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডেড গুঁড়া মশলার বাজার গড়ে উঠেছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার।
উৎপাদনকারীরা বলছেন, জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তনের কারণেই প্যাকেটজাত মশলায় নির্ভরতা বাড়ছে। একটা সময় নারীরা ঘরে থেকে শুধু রান্না ও সন্তান লালনপালনের কাজ করলেও বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেন। অনেক নারী আবার চাকরির পাশাপাশি নিজেদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবেও তৈরি করছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগের উদ্যোগে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় 'স্ট্যাটিস্টিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ-২০১৮' শীর্ষক এক প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে মোট সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫৫। এর মধ্যে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৭৮৭ জন নারী, যা মোট চাকরিজীবীর প্রায় ২৭ শতাংশ। ২০১০ সালে মোট চাকরিজীবীর মধ্যে নারী ছিলেন ২১ শতাংশ। মাঝে সামান্য বেড়ে-কমে সর্বশেষ এই হার দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটিতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তথ্য হালনাগাদ করা হয়েছিল।
লালমাই ফুড প্রডাক্টস লিমিটেডের গুঁড়া মশলার একটি ব্র্যান্ড আরকু। লাইমাই গ্রুপের চেয়ারম্যান হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াসিন টিবিএসকে বলেন, "জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে কিছু মানুষ প্রতি বছরই প্যাকেটজাত গুঁড়া মশলার ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে, এ কারণে প্রতি বছরই ব্র্যান্ডেড মশলার বাজারও বড় হচ্ছে"।
জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বাড়তে থাকা প্যাকেটজাত মশলার বাজার দ্বিগুণ হারে বাড়ছে বলে জানান উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা।
মশলা প্রক্রিয়াজাতকরণ ইন্ডাস্ট্রির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীরা যত বেশি পড়াশোনা ও চাকরির দিকে ঝুঁকছে সংসারে দেয়া সময়ের পরিমাণ তত কমছে। যদিও চাকরির পাশাপাশি সংসারের রান্নার কাজটিও নারীরাই করেন।
এই পরিস্থিতিতে রান্নার কাজকে সহজ করতেই গুঁড়া মশলা। একটা সময়ে গ্রামাঞ্চলে মেশিনে হলুদ, মরিচ গুঁড়া করা হলেও এখন সারাদেশেই প্যাকেটজাত গুঁড়া মশলার একটা কদর তৈরি হয়েছে। এই মশলাগুলোও তৈরি করছে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। আধুনিক সব কারখানা তৈরি করে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে এসব গুঁড়া মশলা।
এর মধ্যে একটি স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজের 'রাঁধুনি' ব্র্যান্ডের গুঁড়া মশলা। প্রতিষ্ঠানটি ২০ বছর আগে প্যাকেটজাত গুঁড়া মশলা বিক্রি শুরু করে। এরপর অনেক বড় প্রতিষ্ঠান মশলার বাজারে আসলেও এখনো পর্যন্ত ৭০ ভাগের বেশি ব্র্যান্ডেড গুড়া মশলার বাজার দখলে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরে এসিআই পিউর, প্রাণ ও বিডি ফুডের গুঁড়া মশলার আলাদা আলাদা মার্কেট শেয়ার ১০ শতাংশের কম।
প্যাকেটজাত গুঁড়া মশলার বাজার সম্মন্ধে জানতে চাইলে স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজের হেড অব মার্কেটিং ইমতিয়াজ ফিরোজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রতি বছর প্যাকেটজাত মশলার বাজার ডাবল ডিজিট গ্রোথ পাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার প্যাকেটজাত গুঁড়া মশলার বাজার তৈরি হয়েছে"।
গুঁড়া মশলার বাজারে পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে এসিআই পিউর, প্রাণ, একমি, বিডি, আরকু ও ফ্রেশ। এছাড়া নতুন প্রতিযোগী হিসেবে মাত্রই বাজারে প্রবেশ করলো বসুন্ধরা গুঁড়া মশলা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলুদ, মরিচ, জিরা, ধনিয়া, গরম মশলা, গরু ও মুরগির মাংসের মশলা, ফুচকা-চটপটির মশলা, বিরিয়ানির মশলা, হালিম মিক্সসহ নানা পদের মশলা বিক্রি করছে।
বসুন্ধরার চীফ অপারেটিং অফিসার (ব্র্যান্ড এন্ড মার্কেটিং) জসিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "আমরা সরাসরি কৃষকের সঙ্গে চুক্তি করেছি। তাদের উৎপাদিত হলুদ, মরিচ নিয়ে এসে আধুনিক কারখানায় মশলা তৈরি করা হচ্ছে।"
তিনি দাবি করেন, তাদের প্যাকেটজাত মশলায় কোন কৃত্রিম ঝাঁঝ বা রঙ যোগ করা হয় না। যে কারণে মশলায় একটা প্রাকৃতিক স্বাদ বজায় থাকে যা গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে।
জানা গেছে, প্যাকেটজাত মশলার পাশাপাশি চিরাচরিত পদ্ধতির নানা পদের গোটা মশলা বাজারে বিক্রি হয়। পেঁয়াজ, আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ, জিরা, ধনিয়া, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গসহ বিভিন্ন মশলা আগে থেকেই তরকারিতে আস্ত ব্যবহার করা একটা পুরনো রীতি। এর মধ্যে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ ব্যাপক আবাদ হলেও তা চাহিদার তুলনায় খানিকটা কম। যে কারণে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের একটা অংশ ভারত ও চায়না থেকে আমদানি করা হয়।
অন্যদিকে জিরা, ধনিয়া, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ সহ বিভিন্ন মশলা ভারতসহ বিশ্বের ২২টিরও বেশি দেশ থেকে আমদানি হয়।
প্রক্রিয়াজাত মশলার উৎপাদনকারীরা বলছেন, প্যাকেটজাত মশলার চাহিদা বাড়লেও এখনো ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির আস্ত মশলার বাজারই বড়। তবে সামগ্রিক মশলার চাহিদা বৃদ্ধির তুলনায় প্যাকেটজাত মশলার চাহিদা দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
প্রাণ আরএলএল গ্রুপের বিপণন বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে বলেন, "প্রতি বছর সামগ্রিক মশলার চাহিদা ২-৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে প্যাকেটজাত মশলার চাহিদা বাড়ছে ১০-১৫ শতাংশ হারে"।
তিনি বলেন, "মানুষের ব্যস্ত জীবনকে সহজ করছে বলেই প্যাকেটজাত মশলার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে"। ১০ বছরে গুঁড়া মশলার রপ্তানি বেড়েছে তিনগুণ।
শুধু দেশে প্যাকেটজাত মশলার চাহিদা বাড়ছে তাই নয়, রপ্তানি থেকে ভালো করছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (ইপিবির) এর তথ্য থেকে জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর ২০২০-২১ এ রেকর্ড পরিমাণ গুঁড়া মশলা রপ্তানি হয়েছে। এ সময়ে ৪৩.২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সমপরিমাণ প্রক্রিয়াজাত মশলা রপ্তানি হয়েছে।
১০ বছর আগে অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছরে মশলা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৩.৬৮ মিলিয়ন ডলার। ১০ বছরে প্রক্রিয়াজাত মশলা থেকে রপ্তানি আয় তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রক্রিয়াজাত এসব মশলার বিশ্বব্যাপী ভালো চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে বাজার তৈরি করেছে। সামনের দিনগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ দ্রুত বাড়বে।