বন্যার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে দিনাজপুরবাসী
২০১৭ সালের ১২ আগস্ট। নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় দিনাজপুর জেলার ১৩টি উপজেলার কমবেশি সব এলাকা। ভয়াবহ ওই বন্যায় পুরো জেলায় মারা যান ২৯ জন মানুষ। ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সড়ক, কৃষি জমির ফসল ও নদীর বাধ।
উত্তরের এই জেলায় কমবেশি প্রতি বছর বন্যার আশঙ্কা থাকে। প্রতি বছরই প্লাবিত হয় বিভিন্ন এলাকা। সামান্য উজানের ঢল ও বৃষ্টিতে এই জেলা নিমজ্জিত হওয়ার মূল কারণ নদী ও খালের গভীরতা কমে যাওয়া। এ ছাড়া মজবুত না হওয়ায় অনায়াসেই ভেঙে যায় বাঁধ। ওই এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা। তবে বন্যার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে এরই মধ্যে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদী খনন ও সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের আগস্টের ওই ভয়াবহ বন্যায় জেলার ১৩টি উপজেলার কমবেশি সব এলাকা প্লাবিত হয়। বাঁধ ভেঙে যায় আত্রাই, কাকড়া, গর্ভেশ্বরী ও পূর্ণভবা নদীর। ওই বন্যায় নিহত হয়েছিল ২৯ জন। এছাড়াও পানিবন্দি হয়ে পড়েন এক লাখ ৫৫ হাজার ৪৭১টি পরিবারের ছয় লাখ ২১ হাজার মানুষ। বন্যার ফলে ২৯৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হয় আর ১৫০ কিলোমিটার সড়ক ভেঙে গর্ত হয়ে যায়। এছাড়াও ২৯টি স্থানে আড়াই কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে যাওয়াসহ ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৮০ কিলোমিটার বাঁধ। প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির ধানের চারা নষ্ট হওয়াসহ বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শুধু ২০১৭ সালেই নয়, ২০১৯ সালেও বেশ কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। যদিও পরে নদীর পানি বৃদ্ধি না পাওয়ায় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছে দিনাজপুরবাসী। ২০১৯ সালেও বিরল ও সদর উপজেলার চারটি স্থানে ঝুকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্যার কবল থেকে মুক্তি পেতে জেলার ১৩টি উপজেলায় ১৪টি নদী ও খাল পুনঃখননের কাজ চলছে। এছাড়া মোট ৫৯টি নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখননের জন্য ‘জেলা পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটি’র সুপারিশক্রমে প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে। চলছে ডিপিপি প্রণয়নের কাজও। শুধু তা-ই নয়, জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি আত্রাই, গর্ভেশ্বরী ও পূর্ণভবা নদীর তীর সিসি ব্লক দিয়ে স্থায়ীভাবে নির্মাণ, নদী খনন ও রেগুলেটর নির্মাণের প্রকল্পও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। একনেক-এ ৪৭৮ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদনের পর কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে বন্যার হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে রক্ষা পাবে এ জেলার প্রায় ২৮ লাখ মানুষ।
দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, প্রায় তিন হাজার ৪৪৪ দশমিক ৩০ বর্গকিলোমিটারের দিনাজপুর জেলায় মোট নদী রয়েছে ১৯টি, যাদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০০ কিলোমিটার। পাশাপাশি খাল রয়েছে ৬৫টি ও বিল অথবা জলাশয় রয়েছে ৭৪টি। এসব নদী, খাল ও জলাশয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ৪টি পানি বক্ষ (ওয়াটার বডি) রয়েছে। এই ৪টি নদী সিস্টেম এবং এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকল নদী, খাল ও জলাশয়ের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রথম পর্যায়ে জেলার ১৩টি উপজেলার ১৪টি নদী ও খাল পুনঃখনন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব খাল খননের কার্যক্রম ১৫ থেকে ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে।
এরই মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৩টি উপজেলায় ৫৯টি নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখননের জন্য প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় রয়েছে ৬টি, বোচাগঞ্জে ৫টি, বিরলে ৫টি, কাহারোলে ৫টি, বীরগঞ্জে ৬টি, ফুলবাড়ীতে ৩টি, পার্বতীপুরে ৬টি, খানসামায় ৪টি, চিরিরবন্দরে ৬টি, বিরামপুরে ৪টি, হাকিমপুরে ৪টি, ঘোড়াঘাটে ২টি ও নবাবগঞ্জে ৩টি নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখননের জন্য প্রস্তাবনায় রাখা হয়েছে।
এদিকে, জেলার পানি নিষ্কাশনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘাগড়া খালের দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খনন কার্যক্রম শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই খালটির প্রায় ১৫ কিলোমিটার খনন করা হবে। তবে এরই মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ খনন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সদর উপজেলার গোষ্ঠেরডাঙ্গা এলাকার আবেদ আলী বলেন, প্রায় প্রতি বছরই বর্ষার সময়ে বন্যার আশঙ্কায় থাকতে হয়। নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দেয়। পাশাপাশি বাধগুলোও তেমন টেকসই না। তাই টেকসই বাধ নির্মাণের পাশাপাশি খননের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন দিনাজপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক যাদব চন্দ্র রায় বলেন, নদীগুলো নাব্যতা সংকটের কারণে সামান্য পানিতেই প্লাবিত হচ্ছে। এসব নদী খনন করা খুবই জরুরি। পাশাপাশি নদীর বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে মেরামত বা নির্মাণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী বাধ স্থায়ীভাবে করা না গেলে অমঙ্গল আমাদের পিছু ছাড়বেনা।
দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফইজুর রহমান জানান, স্থায়ীভাবে বাধ মেরামতের জন্য ৪৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। যা মন্ত্রণালয় ও প্ল্যানিং কমিশন অনুমোদন দিয়েছেন এবং প্রি-একনেকও পাশ করেছে। এখন একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেই সিসি ব্লক দিয়ে বাধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। এছাড়া ছোটখাটো বাধগুলোর ভালভাবে মেরামতের জন্যও ডিপিপি তৈরী করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ে ১৪টি নদী ও খাল খননের কার্যক্রম চলমান রয়েছে যা প্রায় শেষের পথে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৯টি নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখননের প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে। এসব প্রকল্প অনুমোদন পেলেই নদী খনন, রেগুলেটর নির্মাণসহ বন্যা ঠেকাতে সব ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।