গুরুত্বপূর্ণ কুন্দুজসহ দুই দিনে ৪টি প্রাদেশিক রাজধানী দখলে নিল তালেবান
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর কুন্দুজ দখল করেছে তালেবান। দেশটির অন্যতম বড় এ শহর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার মাধ্যমে নতুন করে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের শক্তি ও রণকৌশলের পরিচয় দিল সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
এর আগে গত শুক্রবার দুপুরে নিমরোজ প্রদেশের রাজধানী জারাঞ্জ তালেবানের দখলে চলে যায়। এ ঘটনার ২৪ ঘন্টা পেরোনোর আগেই পতন হয় জাওজান প্রদেশের রাজধানী শেবেরগানের। কিন্তু, বিগত কয়েক দিনের লড়াইয়ে কুন্দুজের নিয়ন্ত্রণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
স্থানীয় এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, কুন্দুজের বিমানবন্দর তালেবান যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে উড়ছে তালেবানের সফেদ পতাকা।
শুক্রবার থেকে এপর্যন্ত মোট চারটি প্রাদেশিক রাজধানী দখল করেছে তালেবান। কুন্দুজ দখলের ঘণ্টাখানেক পর উত্তরাঞ্চলীয় আরেক প্রাদেশিক রাজধানী সার-ই-পুল এ প্রবেশ করেছে সশস্ত্র যোদ্ধারা।
আফগান সরকারের কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করছেন যে, এখনও তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা দখলীকৃত শহরগুলোতে রয়ে গেছেন এবং সেখান থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ, তালেবান সম্পূর্ণ দখল নিয়েছে একথা তারা স্বীকার করছেন না।
সরকারি বাহিনীর মনোবল চাঙ্গা রাখার উদ্দেশ্যেও তারা এমন মন্তব্য করতে পারেন।
দীর্ঘ ২০ বছর লড়াই করেও তালেবানের শক্তি হ্রাস করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী। অবশেষে তারা তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করে আফগানিস্তান ত্যাগ শুরু করা মাত্র সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জরিয়ে পড়ে তালেবান।
বিগত কয়েক মাসে দেশটির অর্ধেকের বেশি জেলা ও গ্রামীণ এলাকা দখলে নেওয়ার পর, তারা নজর দিচ্ছে প্রাদেশিক রাজধানীগুলোর দিকে।
পশ্চিমাঞ্চলের হেরাত এবং দক্ষিণাঞ্চলের দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানী কান্দাহার ও লস্কর গাহ দখলে নিয়েও তীব্র লড়াই চলছে।
চলতি বছরের লড়াইয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিক। উত্তরপূর্বের আসাদাবাদ শহরে শিশু-সন্তানসহ অনেক পরিবার সরকারি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
সেখানকার এক বাসিন্দা গুল নাজ বার্তাসংস্থা এএফপি'কে বলেন, "আমাদের গ্রামে অনেক বোমা ফেলা হয়েছে। তারপর তালেবানরা এসে সবকিছু ধ্বংস করেছে। আমরা অসহায়, তাই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এখন বাচ্চাসহ মাটিতে শুয়ে মানবেতর অবস্থায় থাকছি।"
বাস্তুচ্যুত আরেক অধিবাসী জানান, "প্রথমে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তখন আমার সাত বছরের এক মেয়ে ঘরের বাইরে যায়, তারপর আর তাঁকে খুঁজে পাইনি। সে বেঁচে আছে না মারা গেছে- তাও জানি না।"
পশ্চিমা উপকরণে সজ্জিত ও সংখ্যায় শক্তিশালী হলেও সম্মুখ সমরে তালেবানকে রুখতে পারছে না সরকারি বাহিনী। তাদের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রও তালেবানদের অবস্থানগুলো লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব হামলায় তালেবান যোদ্ধাদের বিপুল সংখ্যায় হতাহত হওয়ার দাবিও করছেন আফগান কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে, তালেবানের দাবি নির্বিচার বিমান হামলার ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। লস্কর গাহ শহরের দুটি হাসপাতাল বিমান হামলায় ধবংস হওয়ার কথা জানায় তারা।
এদিকে আফগান শহরগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হামলা চালানোয় তালেবানের তীব্র সমালোচনা করেছে কাবুলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস। এক বিবৃতিতে মার্কিন দূতাবাস বলেছে, "আফগান শহরাঞ্চলগুলোর বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে জোর করে তালেবানি শাসন চাপিয়ে দেওয়া মেনে নেওয়া হবে না।"
বিবৃতিটি আরও জানায়, "তালেবানরা নাগরিকদের কল্যাণ এবং তাদের অধিকার রক্ষার পরোয়া করছে না। তাদের এ আচরণ আফগানিস্তানে মানবিক সংকটকে গভীর করে তুলবে।"
কুন্দুজ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
গত মে থেকে শুরু হওয়া তালেবানের নতুন সামরিক অভিযানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন কুন্দুজের নিয়ন্ত্রণ।
প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার বাসিন্দার এ শহরকে দেশটির খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতীয় রাজধানী কাবুলসহ অন্যান্য প্রধান শহরের সঙ্গে সড়ক সংযোগ থাকায় কুন্দুজ কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ।
তাজিকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তও রয়েছে কুন্দুজ প্রদেশের। এ সীমান্ত দিয়ে আফগান আফিম ও হিরোইন মধ্য এশিয়ায় পাচার হয়, যা সেখান থেকে পৌঁছানো হয় ইউরোপে। তাই কুন্দুজ নিয়ন্ত্রণের অর্থ এ অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাদক চোরাচালান রুটকেও নিয়ন্ত্রণ করা।
২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনের আগে উত্তরে তালেবানের শক্ত ঘাঁটি ছিল কুন্দুজ। তাই এর প্রতীকী গুরুত্বও রয়েছে। এর আগে ২০১৫ এবং তারপর ২০১৬ সালে তালেবানের হাত থেকে কুন্দুজ দখল করেছিল সরকারি বাহিনী।
- সূত্র: বিবিসি