ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বিধিনিষেধ তুলে নিলে মানুষ ভুল বার্তা পাবে, অভিমত বিশেষজ্ঞদের
দেশে করোনাভাইরাসে পজিটিভ শনাক্তের হার এখনও ২২ শতাশের বেশি, মৃত্যুও দুইশ'র নিচে নামছে না। হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি, আইসিইউয়ের জন্য মানুষের হাহাকার কমেনি।
এরইমধ্যে ১১ আগস্ট থেকে দেশে শিথিল করা হয়েছে লকডাউন, ১৯ আগস্ট থেকে শতভাগ গণপরিবহন চলবে, খুলে যাচ্ছে পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবকিছু খুলে গেলে আগামী দুই সপ্তাহ পর দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।
এসব সিদ্ধান্তে জনগণ ভুল বার্তা পাবে। অসতর্ক হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। তাই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এরপর মৃত্যু ও সংক্রমণের সর্বনাশা স্রোত লক্ষ্য করবে বাংলাদেশ।
সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি পালন সাপেক্ষে, ১৯ আগস্ট থেকে সড়ক, রেল ও নদীপথে গণপরিবহন চলাচল করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এব্যাপারে বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনও জারি করে।
এসময়ে অর্ধেক সক্ষমতায় ব্যবসা করতে পারবে, হোটেল ও রিসোর্টসহ সকল পর্যটন কেন্দ্র ও কমিউনিটি সেন্টার।
প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, গত ৩ আগস্ট দেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেই এ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল। সেখানে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়েও আলোচনা হয়।
এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার দুই সপ্তাহের পর সংক্রমণ হার ৩০ শতাংশ ছাড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে আগস্টের শেষ সপ্তাহে ভয়াবহ অবনতি হতে পারে দেশের মহামারি পরিস্থিতি।
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল আটটা নাগাদ গত ২৪ ঘণ্টায় টানা ১৯ দিনের মতো দুই শতাধিক মৃত্যু হয়েছে। এসময় মারা গেছেন ২১৫ জন। মত মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩,৬১৩ জনে। কোভিড পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন ১০,১২৬ জন, যা মিলিয়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৮। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত বা পজিটিভিটি রেট এখন ২২.৪৬ শতাংশ।
এব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মোস্তাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত তিনদিন ধরে করোনাভাইরাসে পজিটিভিটি রেট ২৫ শতাংশের এর নিচে; কিন্তু সেটি স্থিতিশীল কিনা- এখনও বোঝা যাচ্ছেনা। দুই সপ্তাহের বেশি সময়ের লকডাউনের কারণে এখন সংক্রমণ চিত্র কিছুটা কমতির দিকে। কিন্তু, সবকিছু খুলে গেলে দুই সপ্তাহ বা তার কিছুদিন পর সংক্রমণ আরো অনেক বাড়বে। তখন হয়তো আবার সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হবে।"
তিনি বলেন, সংক্রমণ বেড়ে গেলে মৃত্যু বাড়ে, "বারবার লকডাউনে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এখন থেকে স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। যাতে বারবার সারাদেশে লকডাউন দিতে না হয়। পজিটিভ রোগীদের আইসোলেশন করতে হবে এবং তাদের আইসোলেশনে থাকার সময় সহায়তা করতে হবে। তাহলে সংক্রমণ ছড়াবে না, অর্থনীতিও বাঁচবে। আর মাস্ক পরা ও শতভাগ ভ্যাকসিনেশনে জোর দিতে হবে।"
এনিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল টিবিএস'কে বলেছেন, "সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে আমি খুব ভয় পাচ্ছি। এখনি পজিটিভিটি রেট ২২ শতাংশ যা অনেক বেশি, পজিটিভিটি রেট যেখানে ৫ শতাংশের নিচে হলে সংক্রমণ কমেছে বলা যায়। এরইমধ্যে সব খুলে দিলে কিছুদিন পর সব মানুষ আক্রান্ত হবে, তাদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল অনেক রোগী মারা যাবে। আগস্টের শেষে পজিটিভিটি রেট আবার ৩০ শতাংশ ছাড়াতে পারে।"
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, "ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো এখনও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ঢাকার ১৭টি ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে ১০টিতেই কোনো আইসিইউ শয্যা খালি ছিল না বৃহস্পতিবারে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চাইতেও বেশি রোগী ভর্তি ছিল।"
এর আগে গত রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, "হাসপাতালগুলো আর রোগী সংকুলান করতে পারছে না। তবে পরিস্থিতির উত্তরণে সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।"
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, "আমরা মৃত্যুর হার কমাতে চাই। শুধু সরকার পারবে না, সবাইকে প্রয়োজন। নিজেদের সুরক্ষা নিজেদের করতে হবে। বাসে-ট্রেনে গাদাগাদি করে চললে চলবে না। তাহলে আবার সংক্রমণ বাড়বে।"
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, "করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে আর না বাড়ে সে জন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। করোনা বেড়ে গেলে সামাল দেওয়া যাবে না। রাতারাতি হাসপাতাল বাড়ানো যাবে না। হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু, এটারও একটা সীমা রয়েছে।"
মহাপরিচালক বলেন, "ডিএনসিসি'তে এক হাজার শয্যা হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে এবং অতিসম্প্রতি সময়ে বঙ্গমাতা ফিল্ড হাসপাতালে তৈরি করা হয়েছে। তবে আর হাসাপাতালে শয্যা বাড়ানো সম্ভব হবে না।"
করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে আবারও বিধিনিষেধ: জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী
করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে আবারও বিধিনিষেধ জারি করা হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিককের একথা বলেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, জীবন-জীবিকার তাগিদে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে আবারও বিধিনিষেধ দেওয়া হবে।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে সরকারের পরবর্তী কৌশল কী হবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ হোসেন বলেন, "দুটি কৌশলই আমরা অবলম্বন করব। একটা হলো বিধিনিষেধ বা লকডাউন, আরেকটি হচ্ছে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।"
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর যে কোনো দেশে সংক্রমণ বাড়লেই, যেমন অস্ট্রেলিয়াতে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে, কারফিউ দেওয়া হয়েছে, সেখানে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। আমেরিকাতেও দেওয়া হয়েছে। কারণ এর কোনো বিকল্প নেই।
ফরহাদ হোসেন বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়, আমরা ঝুঁকির মধ্যে আছি। মাস্ক পরাসহ সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।