লক্ষ্মীপুরে ৫০ কোটি টাকার রেণু পোনার ব্যবসা
গত বছর লক্ষ্মীপুরে বিভিন্ন পুকুর, জলাশয় এবং মেঘনা নদী থেকে ৬৩ হাজার মেট্রিকটন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। যার মধ্যে ৪২ হাজার মেট্রিকটন মাছই ছিল চাষীদের উৎপাদিত কার্প জাতীয় সাদা মাছ। এ মাছ উৎপাদনে বছর জুড়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকার রেণু পোনা মাছের ব্যবসা হয়। লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য অফিসের দেয়া তথ্যে এমনটি জানা গেছে। তবে স্থানীয় রেণু পোনা ব্যবসায়ীদের দাবী, লক্ষ্মীপুরে প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার পোনা মাছ ক্রয়-বিক্রয় হয়।
রেণু উৎপাদন ও ব্যবসায় সরকারি-বেসরকারি হ্যাচারি, মৎস্য নার্সারি এবং মাছের খামারে প্রায় ৫-৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
জেলার রায়পুর মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রের কর্মকর্তারাদের দাবি , মানসম্মত রেণু পোনা উৎপাদনে লক্ষ্মীপুর সারাদেশে সুপরিচিত।
মাইকের ঘোষক মোঃ শাহজাহান জানান, বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে প্রায় ৪ মাস প্রতিদিন তিনি বিভিন্ন নার্সারি ও খামারির মাছ বিক্রয়ের মাইকিং করেন। এসময় লক্ষ্মীপুরের গ্রামগঞ্জের রাস্তা ও সড়কে প্রতিদিনই মাছের পোনা বিক্রির মাইকিং শোনা যায় বলেও জানান তিনি। পোনা নার্সারি ও খামারিরা তাদের উৎপাদিত পোনা বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে। মাইকিংয়ে তথ্য জানার পর খামারি ও চাষীরা মাছের পোনা সংগ্রহ করেন। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পোনা ক্রয়-বিক্রয় চলে। মাছ চাষী হাজী আলা উদ্দিন জানান, জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে ১০-১২ জন স্থায়ী পোনা ব্যবসায়ী আছে।
জেলা ট্রাক মালিক সমিতির শ্রমিক মোঃ আবদুস সালাম জানান, বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে লক্ষ্মীপুরে গড়ে ৩০ ট্রাক পোনা মাছ আসে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাতিলে করে এনে লক্ষ্মীপুরে পোনা বিক্রি করে অনেক ব্যবসায়ী।
এদের কোন পরিসংখ্যান কারো কাছে জানা না থাকলেও মাছ চাষী হাজী আলা উদ্দিন জানান, পোনা হকারীদের মাধ্যমেও লক্ষ্মীপুরে প্রতি মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার পোনা বিক্রি হয়। এরা মূলত কুমিল্লা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও লাকসাম থেকে এসে লক্ষ্মীপুরে পোনা মাছ বিক্রি করে।
জেলায় মাছের নার্সারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম মীর শিব্বির আহমেদ। ২০১০ সালে কমলনগরের তোরাবগঞ্জ গ্রামে তিন একর জমিতে তিনি গড়ে তোলেন অয়ন এগ্রো ফিশারিজ নামের একটি সমন্বিত খামার। তিন বছরে তার খামারকে রূপান্তরিত করেছেন পোনা মাছের নার্সারি হিসেবে। তিনি হ্যাচারি থেকে ৩-৪ দিনের রেণু এনে ১২-১৫ সেমি সাইজ করে বিক্রি করে থাকেন। পাঙ্গাস, শিং, চিতল, কোরাল, কৈ, মাগুর, খলসে, বোয়াল, পাবদা, শোলসহ ১০-১৫ জাতের দেশীয় এবং ৮ জাতের কার্প মাছের পোনা বিক্রি করেন শিব্বির। লক্ষ্মীপুর ছাড়াও আশপাশের বহু জেলার চাষীরা তার নার্সারি থেকে পোনা সংগ্রহ করেন। তিনি জানান, গত বছর প্রায় ১০ লাখ কার্প মাছের পোনা বিক্রি করেছেন। শিব্বিরের মৎস্য নার্সারিতে প্রতিদিন ৫-৬ জন শ্রমিক কাজ করে। সকল খরচ বাদে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় তার।
অন্যদিকে রায়পুর উপজেলার পৌর শহরের মধ্যে ইউছুপ হ্যাচারির অবস্থান। বিগত প্রায় ৩০ বছর যাবত হ্যাচারি ব্যবসার সাথে জড়িত ইউছুপ। করোনার কারণে গত ২ বছর যাবত দেশের অন্যান্য প্রান্তের ক্রেতারা তেমন আসছে না। তবুও গত বছর প্রায় ৩০০ কেজি রেণু বিক্রি করেন তিনি। ৩ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন ইউছুপ। ইউছুপ জানান, তার খামারে বিক্রিত রেণু থেকে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি মাছ উৎপাদন হয়। ইউছুপের আশেপাশে রয়েছে আরো ৬টি বেসরকারি হ্যাচারি। যেগুলোতে উৎপাদিত রেণু থেকেও প্রায় আরো ৪ কোটি পোনা হয়।
সদর উপজেলার চর মনসা গ্রামে ২০ একর জায়গা জুড়ে ফজর আলী গড়ে তোলেন এগ্রো কমপ্লেক্স। সেখানে রয়েছে ১১টি বড় পুকুর। এ পুকুরগুলোতে প্রতি বছর প্রায় ৫-৬ লাখ পোনা ছাড়া হয়। স্থানীয় নার্সারি ও হ্যাচারি থেকে তা সংগ্রহ করেন মালিক মোঃ ফজর আলী। শুধু পোনা ক্রয় বাবদ তার বার্ষিক খরচ অন্তত ১০ লাখ টাকা।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠা বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার কেজি বিভিন্ন জাতের রেণু পোনা উৎপাদিত হয়। প্রতিকেজি রেণু থেকে প্রায় ১ লাখ পোনা পাওয়া যায়। প্রতি কেজি রেণু জাত হিসেবে ২-১০ হাজার টাকায় নার্সারি ও খামারিদের নিকট বিক্রয় করা হয়। নার্সারি মালিকরা কিছুদিন লালনের পর পোনা হিসেবে খামারি ও চাষীদের নিকট শত হিসেবে বিক্রি করে থাকেন। স্থানীয় রেণু থেকে উৎপাদিত পোনা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কোটি কোটি মাছের পোনা আনা হয়।
মাছের রেণু উৎপাদনের জন্য জেলায় ২টি সরকারি মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৯টি তালিকাভুক্ত হ্যাচারি এবং ১০১টি মৎস্য নার্সারি রয়েছে। কিন্ত মৎস্য বিভাগের তালিকাভুক্তি ছাড়াও ৫ উপজেলায় আরো অন্তত ৫০০ মৎস্য নার্সারি রয়েছে বলে জানিয়েছেন রেণু ব্যবসায়ী শিব্বির আহমেদ।যেগুলোর মধ্যে রায়পুর মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি দেশের ৭৬টি সরকারি হ্যাচারির মধ্যে সবচেয়ে বড়। উক্ত কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ওয়াহিদুর রহমান মজুমদার জানান, রায়পুর মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রে চলতি বছর ১ হাজার ৫৩ কেজি রেণু এবং ১৮ লাখ পোনা উৎপাদিত হয়েছে। দেশের কার্পজাতীয় মাছের পোনার চাহিদার বড় একটি ভাগ রায়পুর হ্যাচারি থেকে মেটানো হয়। এ প্রজনন কেন্দ্রে ৭৫টি পুকুর এবং ১১ হাজার কেজি মা-মাছ রয়েছে। এখানকার বেশিরভাগ মা-মাছ হালদা নদী ও যমুনা নদী থেকে সংগ্রহ করা হয় বলেও জানান তিনি। সেখানে ১১ প্রজাতির কার্প মাছ এবং দেশি শিং, কৈ ও পাঙ্গাস মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদিত হয়।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন জানান, লক্ষ্মীপুর জেলায় ৩৪ হাজার ১২৫ জন তালিকাভুক্ত মাছ চাষী এবং ৮ হাজার ১৭ হেক্টর জলাশয় রয়েছে। এসকল চাষী ও জলাশয়ের মাছের জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার পোনা ব্যবসা হয়।
২০১১ সালের আদমশুমারী তথ্যে জেলায় ৪৪ হাজার পুকুর ও দিঘির কথা উল্লেখ রয়েছে। জেলার প্রতিটি শহর ও গ্রামগঞ্জের পুকুর জলাশয়ে সাদা মাছ চাষ করা হয়। মাছ চাষী ফজর আলী জানান, সরকারি তালিকার বাইরেও হাজার হাজার চাষী রয়েছে যাদের মাছ চাষের জন্য জেলা ও জেলার বাইরে থেকে অনন্ত ১০০ কোটি টাকার পোনা ক্রয়-বিক্রয় হয়।
গত বছর ৪২ হাজার মেট্রিকটন সাদা মাছের পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর জেলায় একই সময়ে মেঘনা নদী থেকে ২১ হাজার মেট্রিকটন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এছাড়া জেলার মেঘনা নদী থেকে প্রতি বছর ৬০০ কোটি টাকার চিংড়ি রেণু আহরণ করা হয়।