দু'জনের মধ্যে কে হবেন পরবর্তী আফগান সরকার প্রধান?
তালেবানের শীর্ষ নেতাদের পরিচয় ও জীবনী একটি বিশেষ কারণে অস্পষ্ট করে রাখা হয়। কারণ এখানে গোপনীয়তাই অনেক সময় বেঁচে থাকার প্রধান উপায়।
তালেবান গোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিলো মোল্লা মোহম্মদ ওমরের হাত ধরে। ১৯৯৬ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর, আবার যখন ২০০১ সালে মার্কিন বাহিনী দ্বারা উচ্ছেদের শিকার হয়, তখন মোল্লা ওমর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে, মার্কিন বাহিনী বছরের পর বছর ধরে তাকে খুঁজে বেড়িয়েছিলো।
পরবর্তীতে ২০১৩ সালে পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। তবে, পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত তার মৃত্যুর সংবাদকে প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি।
এরপর তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে ওমরের উত্তরসুরী হন মোল্লা মোহম্মদ মনসুর; তিনিও ২০১৬ সালে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হন। আর এখন তালেবানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার। তিনি দীর্ঘ আট বছর পাকিস্তানের একটি কারাগারে বন্দি ছিলেন।
গত সপ্তাহে কাবুল পতনের পর তালেবান গোষ্ঠী সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক ধারণা করছেন, বারাদার এবং মনসুরের উত্তরসূরি হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদাও আফগানিস্তানের পরবর্তী নেতা হতে পারেন।
হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদা, তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা
যদিও শীর্ষ তালেবান নেতা হিসাবে সংগঠনটিতে হায়বাতুল্লাহ'র দাপট নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু কাবুলের নতুন সরকার কাঠামোতে জনসম্মুখে তার আবির্ভাব হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিশ্লেষকরা বলছেন, আখুনজারা পর্দার পিছনে থেকে বারাদার ও অন্যান্য নেতাদের হাতেই হয়তো শাসনভার ছেড়ে দিবেন।
উইলসন সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর ও দক্ষিণ এশিয়ার উর্ধ্বতন সহযোগী মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, সাধারণত, তালেবানের সর্বোচ্চ নেতারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। তাদেরকে জনসম্মুখে আসতে দেখা যায় না বললেই চলে।
হায়বাতুল্লাহকে বছরের পর বছর ধরে জনসমক্ষে আসতে দেখা যায়নি। তাই তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা এ নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন।
ধারণা করা হয়, হায়বাতুল্লাহ'র বয়স ৬০ এর কাছাকাছি এবং তিনি তালেবান আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি কান্দাহারের বাসিন্দা। তিনি আফগানিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম নুরজাই- গোত্রের সদস্য। তাই অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তার ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় তাকে আফগানিস্তানের পরবর্তী নেতা হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রাখবে।
তবে সরকার ব্যবস্থায় হায়বাতুল্লাহ সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন বলে সব বিশ্লেষকগণ একমত নন।
মোল্লা আবদুল গনি বারাদার
হায়বাতুল্লাহর পর বারাদারকেই বিশ্লেষকগণ আফগানিস্তানের পরবর্তী নেতা হতে পারেন বলে মত দিয়েছেন। তালেবান নেতাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে পরিচিত মুখ।
৫২ কিংবা ৫৩ বছর বয়সী বারাদার তালেবানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা। কান্দাহারের উত্তরের প্রদেশ উরুজগানে তার জন্ম। তবে বেড়ে উঠেছেন কান্দাহার শহরেই। তিনি পোপালজাই বংশের সোদাজাই গোষ্ঠীর সদস্য। সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইও একই বংশের লোক।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত হামলা দমন এবং পরবর্তীতে মার্কিন ও আফগান সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করার অভিজ্ঞতা বারাদারের আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করেন, - ভার্জিনিয়ার স্কুল অফ পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক মেহরজাদ বোরোজার্দি।
বারাদার তালেবান সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি মোল্লা ওমরের বোনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে এমন গুঞ্জনও শোনা যায়।
ওমর যখন মার্কিন বাহিনী হাত থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, তখন কার্যত বারাদারই তালেবান গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব আর্মড গ্রুপস এর সহ-পরিচালক অ্যাশলে জ্যাকসনের মতে, তালেবানের ভিরতে কিংবা বাইরে বারাদারকে যথেষ্ট চিন্তাশীল এবং স্বাধীনচেতা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
"তবে তার ব্যাপারে আমরা খুব বেশি কিছু জানিনা",- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২০১০ সালে পাকিস্তানের করাচি শহর থেকে গ্রেফতার হন বারাদার। কুগেলম্যান বলেন, "সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে গোপনে আলোচনা করছেন এমন সন্দেহে তাকে আটক করা হয়।"
২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের কারাগারেই বন্দি ছিলেন। তবে ট্রাম্প প্রশাসন তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করলে তাকে মার্কিন অনুরোধে মুক্তি দেয়া হয়। পরে তিনি দোহায় অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনায় অংশ নেন।
গত সপ্তাহে কাবুল দখল করে নেয়ার পর তিনি চীন, রাশিয়া, ইরান এবং তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে এবং বিছিন্নতাবাদী দল হিসেবে তালেবানের যেই ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে গত দুই দশকে, সেটি মুছতে বারাদার চেষ্টা করছেন, বলে মন্তব্য করেছেন অধিকাংশ বিশ্লেষকগণ।
বারাদার কিংবা হায়বাতুল্লাহ কেউই হয়তো দীর্ঘদিন তালেবানের নেতৃত্বে থাকবে না। তবে, কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধ এবং সহিংসতার মাঝেও তালেবান গোষ্ঠীর মাঝে ভাঙন দেখা যায়নি।
জ্যাকসন বলেন, "কয়েক বছরের মধ্যে বারাদার তালেবান গোষ্ঠীর সবচেয়ে পরিচিত মুখ হলেও, আরও অনেক নেতাই রয়েছেন। এবং বিশ্লেষকগণ ও কূটনীতিকরা তাদের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানেন না। আগামী কয়েক সপ্তাহ এবং মাস পশ্চিমা সরকার এবং সাংবাদিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়; কারণ আমরা সে সব নেতাদের বুঝতে শুরু করতে যাচ্ছি যারা আফগানিস্তান শাসন করবে।"
- সূত্র: এনপিআর