১১ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা
চলতি বছরের জুন মাসের শেষে দেশের ১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের জুন (২০২১) প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
মোট ১৪ হাজার ৮৭৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ঘাটতির সিংহভাগই জনতা, বেসিক, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংক। এ বছরের মার্চ শেষে এই ১১ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১২ হাজার ৬৪৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশাল ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ছাড়াও এই তালিকায় আছে বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কারণে চলতি বছরেও ঋণ পরিশোধে শিথিলতা রয়েছে। ফলে মন্দ বা খেলাপি ঋণ বাড়লেও ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ এসব ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীর অর্থ। আমানতকারীর অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়ায় তা আদায় হচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ছাড়ের কারণে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে। প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক শূন্য ১৮ শতাংশ।
গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ৪৭১ কোটি টাকার বেশি।
আলোচিত সময়ে যে ১১ ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে তার মধ্যে সরকারি চার ব্যাংকের ঘাটতি ১১ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে সব চেয়ে ঘাটতি জনতা ব্যাংকের।
জুন শেষে জনতার ব্যাংকের ঘাটতি দাড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৫১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর পরই বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৭১ কোটি ৭১ লাখ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ৫২৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ৯৪৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
বেসরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৩৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের। জুন মাস শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দুই হাজার ৩৯৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৪৮২ কোটি ৪০ লাখ, ঢাকা ব্যাংক ২০৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, সোশাল ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৫ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতি ১০৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২১ কোটি ৬ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত (উদ্বৃত্ত) অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখেছে। ফলে চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৭০ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬৫ হাজার ৩৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি এখন ৫ হাজার ৫৮২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের (এসএমই) বিপরীতে সবচেয়ে কম দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ক্রেডিট কার্ডে রাখতে হয় সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি।
এছাড়া নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে প্রভিশনিং করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে এতে ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডাদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।