শাকসবজি রপ্তানি ৩০% বৃদ্ধি করতে চায় সরকার
আগামী বছরগুলোতে শাকসবজি রপ্তানির পরিমাণ ২৫-৩০ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানির পরিমাণ বছরে দুই শতাংশ হারে কমিয়ে আনতে চায় সরকার।
এরই অংশ হিসেবে রাজধানীর শ্যামপুরে বিদ্যমান কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর করতে চাইছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
২০২৩ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার স্যানিটারি এবং ফাইটোস্যানিটারি পরিমাপ সংক্রান্ত চুক্তি (এসপিএস চুক্তি) এবং ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ট প্রটেকশান কনভেনশন (আইপিপিসি) পরিপালনের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আলু, পানসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফল রপ্তানি বাড়বে বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি আমদানি পর্যায়ে কৃষিপণ্যের রোগ বালাই শনাক্তকরণের মাধ্যমে দেশের কৃষি উৎপাদন নিরাপদ হবে বলেও আশা করা হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকে নেয়া একটি প্রকল্পের আওতায় শ্যামপুরের প্যাকেজিং হাউজে সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রে ল্যাব স্থাপন করা হয়েছিল। উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনশক্তির অভাবে এ ল্যাবটি কার্যকর না হওয়ায় এসপিএস চুক্তি ও আইপিপিসি পরিপালন সম্ভব হচ্ছে না।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ এক্রেডিটেশন বোর্ডের এক্রেডিটেশান পেতে ল্যাবটির মান উন্নয়নে ১৫৬.৩৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভা শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান ও একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।
এ সময় প্রতিমন্ত্রী বলেন, উন্নত বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মান যাচাই করে কৃষিপণ্য রপ্তানির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি জানান, বর্তমানে কৃষি থেকে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়। সঠিকভাবে মান যাচাই করে কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
পাশাপাশি কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যাতে করে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম আরও বাড়ে। পাশাপাশি কৃষিপণ্য রপ্তানির জন্য আরও সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ প্রকল্পটির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শাকসবজি ও কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্ত হবে বলে আশা করছেন এ খাতে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ ফল, সবজি এবং সংশ্লিষ্ট পণ্য রপ্তানিকারক সমিতির উপদেষ্টা মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, "মাইকোলজি, ব্যাকটেরিওলজি, ভাইরোলজি, নেমাটোলজি, মাইক্রোবায়োলজি ধরনের পরীক্ষাগুলো করতে পারলে রপ্তানিতে আমরা অনেক এগিয়ে যাবো। তবে এর বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দক্ষ জনবলের দরকার রয়েছে। এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে"।
লন্ডনে নিয়মিত সবজি রপ্তানি করে আলম ওভারসিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এর প্রোপাইটর মাহবুবুল আলম বলেন, "আমাদের পণ্যগুলোর পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য বাইরের অনেক ল্যাবে যেতে হয়। কারণ ইউরোপের দেশগুলো মানের দিক থেকে কোন ছাড় দেয় না। এক্ষেত্রে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন পণ্যের জন্য ল্যাবরেটরি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং এতে দ্রুত যে কোন পণ্যের পরীক্ষা- নীরিক্ষা করা যাবে"।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং এর অতিরিক্ত পরিচালক মো. শামছুল আলম টিবিএসকে বলেন, "সবজি, ফলে অনেক ধরনের রোগ জীবাণু, পোকামাকড়, ব্যাকটেরিয়া, বিভিন্ন ধরনের দূষণ থাকে। সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজে ল্যাবরেটরি থাকলে আমরা পণ্যগুলো কমপ্লাই করে তবেই রপ্তানি করতে পারবো। এতে আমাদের পণ্যের মান যেমন ঠিক থাকবে তেমনি দেশের ভাবমূর্তিও ভালো থাকবে। যা রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে"।
সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজের উপপরিচালক সিপিএইচ লুৎফর টিবিএসকে বলেন, "ইউরোপে পণ্য রপ্তানিতে অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। তারা চায় নিয়মিত পণ্যগুলোর পরীক্ষা-নীরিক্ষা। যেমন পানে সালমোনেলা রয়েছে কিনা তা নির্দিষ্ট চালান ধরে পরীক্ষা করতে হয়। নিজেদের ল্যাব থাকলে এই কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে"।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে স্বীকৃতি থাকলেও বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণে শাক সবজি তথা উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানি হয় তার পরিমাণ ১.৮৬ কোটি টন। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে মাত্র ৯.৯৫ লাখ টন সবজি, যা রপ্তানির মাত্র ৫.৩৫ শতাংশ।
কয়েক বছর আগেও আমদানির ১১ শতাংশ শাকসবজি রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। বিপুল পরিমাণ আমদানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবজির রপ্তানি না বাড়ায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ছে বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এসপিএস চুক্তি ও আইপিপিসি'র বিধিবিধান পরিপালনে ব্যর্থতার কারণে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে আলু ও পানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফসল রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। উদ্ভিদ সংগনিরোধ কার্যক্রমে বালাই শনাক্তকরণে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি স্থাপনের নিমিত্তে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করা এবং কৃষিপণ্য রপ্তানি ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা।
প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ৩১৫ বর্গফুট বিদ্যমান উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরি ভবন, ভৌত অবকাঠামো মেরামত, ল্যাবরেটরি (মাইকোলজি, ব্যাকটেরিওলজি, ভাইরোলজি, নেমাটোলজি, মাইক্রোবায়োলজি ইত্যাদি) যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপন করা হবে। ১৮০ জন কর্মকর্তাকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ ও ৬ কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
প্রকল্পটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ সংরক্ষণ কনভেনশনের স্ট্যান্ডার্ড সেটিং বডির প্রণীত বিধি-বিধান অনুসরণ করার দক্ষতা অর্জন করতে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রায় অর্ধেক জনশক্তি কৃষিতে নিয়োজিত থাকলেও কৃষি জমির ওপর জনসংখ্যার অব্যাহত চাপ, কৃষি জমি অন্য খাতে চলে যাওয়া, আমদানি করা কৃষিপণ্যের সঙ্গে বা বিভিন্ন উপায়ে বালাই প্রবেশ করে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানিতে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত একনেক সভায় ৫৪৪১.৬৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে মোট আটটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ সব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হবে ৩৩৩২.৭২ কোটি টাকা।
এছাড়াও বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে ৪৭.৯৩ কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণ থেকে ২০৬০.৯৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
ময়মনসিংহের কেওয়াটখালি এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর একটি সেতু নির্মাণ করতে ৩২৬৩.৬৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১৩৫৩.৮৩ কোটি টাকা ও চীনভিত্তিকে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের ঋণ থেকে ১৯০৯.৮০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।