দেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল অঞ্চল গাজীপুরের রাস্তা মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন
দেশের অন্যতম প্রধান পোশাক কারখানা স্টাইলিশ গার্মেন্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও মালিক সালাউদ্দিন চৌধুরী। কিছুদিন আগে এক সকালে তার গাজীপুরের কারখানায় একজন মার্কিন ক্রেতার সঙ্গে বৈঠক ছিল।
কিন্তু, ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কের যানজটের কারণে ওই ক্রেতা সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। ফলে রাজধানীর গুলশান এলাকায় একটি পাঁচ তারকা হোটেল বুক করে বৈঠক করতে হয় সালাউদ্দিনকে।
সালাউদ্দিন বলেন, 'উনি আমার কারখানায় গেলে আমরা তাকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাতে পারতাম।'
ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুর দেশের অন্যতম শিল্পকেন্দ্র। সাড়ে ৪ হাজারের বেশি কারখানা গড়ে উঠেছে এখানে। কিন্তু একটি বড় সড়ক অবকাঠামো নির্মাণেরর কাজ চলমান থাকায় এই শিল্পকেন্দ্রই এখন বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার কাজের জন্য শিল্পের সম্পূর্ণ সরবরাহ চক্র তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেই, সেইসঙ্গে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এই পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী যাত্রীরাও।
২০১২ সালে ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে যানজট নিরসনে সরকার দেশের প্রথম বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প (বিআরটি-৩) হাতে নেয়। প্রকল্পটি ২০১৬ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হয়নি।
নির্মাণাধীন বিআরটি-৩ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পাঁচ বছর পিছিয়ে যাওয়ায় মহাসড়কের এই যানজটকে এখন অন্তহীন বলেই মনে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি শুরু করা হয়েছিল দুর্বল সম্ভাব্যতা যাচাইকরণ গবেষণার উপর ভিত্তি করে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ত্রুটি সংশোধন করতে বারবার নকশায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। এর ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পের খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯.৮৪ কোটি টাকা। সেই খরচ এখন দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে 8 হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় ঠেকেছে। অথচ গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬১ শতাংশ।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা:
পোশাক শিল্প ছাড়াও বেক্সিমকো এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মতো অনেক শিল্পগোষ্ঠীও গাজীপুরে শিল্প পার্ক স্থাপন করেছে। সরকারও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য শহরটিতে শ্রীপুর ইকোনমিক জোন এবং বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি স্থাপন করছে।
গাজীপুরে তিনটি মোবাইল ফোন কোম্পানির—ওপো, শাওমি ও টেকনো—অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট রয়েছে।
২০.৫ কিলোমিটার বাস র্যাপিড ট্রানজিট গত নয় বছর ধরে নির্মাণাধীন। এর ফলে ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়ক অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে গেছে।
ঢাকা-গাজীপুর হাইওয়ের অনেক অংশই ভাঙাচোরা। বেশিরভাগ সময়ই এ মহাসড়কে যানজট লেগে থাকে। ফলে বিদেশি ক্রেতা ও কোম্পানির নির্বাহীরা কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
উত্তরা এলাকা থেকে প্রতিদিন গাজীপুরে যান ফোন সংযোজনকারী প্ল্যান্টের অনেক চীনা কর্মকর্তারা। তারা জানান, প্রতিদিন কর্মস্থলে যেতে এবং বাসায় ফিরতেই দিনের অনেকটা সময় খরচ হয়ে যায় তাদের।
জরাজীর্ণ রাস্তার কারণে কারখানা থেকে কাঁচামাল এবং উৎপন্ন পণ্য পরিবহন বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ; পণ্য উৎপাদনে সময়ও লাগছে বেশি।
কখনও কখনও পোশাক কারখানার মালিকদেরও রাস্তায় বিলম্ব হওয়ার কারণে চালানের সময়সীমা মিস করে বসার উপক্রম হয়। অনেক কারখানা সময়ের ঘাটতি পোষানোর জন্য সারা রাত কাজ করে।
মহাসড়কে যানজটের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় কারখানার শ্রমিকদেরও।
নির্মাণকাজের গতি বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা বাস র্যাপিড ট্রানজিট বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে রাতের বেলা কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বহুজাতিক কোম্পানি নেসলে বাংলাদেশের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক নকিব খান বলেন, তীব্র যানজট এবং ধূলিময় পরিবেশের জন্য গাজীপুরে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চালানো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি জানান, তাদের কারখানা গাজীপুরে হলেও তাদের অধিকাংশ কর্মচারী প্রতিদিন ঢাকা থেকে সেখানে যান।
নকিব খান আরও বলেন, 'অফিসে পৌঁছাতে প্রতিদিন আমার প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগে। এই দীর্ঘ যাত্রা একটা গুরুতর মানসিক চাপ। এছাড়া এর ফলে কর্মঘণ্টাও কমে গেছে।'
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত আট বছরের দীর্ঘ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয় মানুষ ও ব্যবসায়ীদের প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, 'প্রতিদিন হাজার হাজার পণ্যবাহী যান, বাস এবং মোটরবিহীন যানবাহন রাস্তায় চলাচল করে, কিন্তু সে তুলনায় সার্ভিস লেন অপ্রতুল।'
অর্থনীতিবিদদের মতে, নির্মাণকাজে সৃষ্ট যানজটের কারণে ব্যবসায় অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'জনগণকে বিপুল পরিমাণ হিডেন কস্ট বহন করতে বাধ্য করা হয়েছে, কিন্তু এটা নিয়ে কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই।'
অন্তহীন ভোগান্তি:
প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে ব্যবসা ও কর্মসূত্রে ঢাকা ও গাজীপুরে যাতায়াত করতে হয়।
গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে প্রতিদিন ঢাকার তেজগাঁওয়ে আসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সাজ্জাদুর রহমান (৩৫)। তিনি বলেন, 'অফিসে আমার পৌঁছতে ৩-৪ ঘণ্টা লেগে যায়। আমার মনে হয়, আমি যেন একটি উন্নয়নের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি।'
পরিবহন চালক এবং মালিকরদের অনুভূতিও সাজ্জাদুর রহমানের মতোই।
ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস সার্ভিস পরিচালনাকারী গাজীপুর পরিবহনে কর্মরত মোহাম্মদ আলম বলেন, আগে তিনি দিনে অন্তত চারটি ট্রিপ দিতে পারতেন। কিন্তু এখন দৈনিক দুটির বেশি ট্রিপ দিতে পারেন না। ফলে তার আয় আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।
মোহাম্মদ আলম বলেন, 'সময় নষ্ট হওয়া ছাড়াও যানজটের কারণে প্রতি ট্রিপে আমাদের জ্বালানির পেছনে আরও ৫০০ টাকা বাড়তি খরচ হয়।'
পরিবহন মালিকরা জানান, প্রায় দেড় হাজার আন্তঃজেলা বাস ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে চলাচল করে।
প্রায় পুরো রাস্তার অবস্থাই বেহাল। তবে টঙ্গী বাজার থেকে চেরাগ আলী পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এই ৩ কিলোমিটার রাস্তা অসংখ্য গর্তে ভর্তি।
ঢাকা-টাঙ্গাইলগামী বিনিময় পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ নাসির বলেন, 'জ্বালানি খরচ ছাড়াও গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খরচও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে আমাদের আয় কমে গেছে অনেক। প্রতিট্রিপে বাড়তি ৫০০ টাকা খরচ হচ্ছে।'
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. শওকত আলী বাবুল বলেন, রাস্তায় প্রচণ্ড যানজটের কারণে যাত্রীরা এখন বাসের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে। ঢাকা আসার জন্য তারা এখন ট্রেন ব্যবহার করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
পণ্যবাহী যানবাহন, বিশেষ করে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের জন্য ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়ক এক দুঃস্বপ্নের নাম। অতিরিক্ত জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বহনের জন্য পণ্যবাহী যানবাহনের মালিকরা ভাড়া বাড়িয়েছেন।
কাভার্ড ভ্যানমালিক তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার জানান, তারা চট্টগ্রামে মাল পরিবহনের জন্য ১৩ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা ভাড়া নিতেন। কিন্তু এখন তারা ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা ভাড়া নেন।
তোফাজ্জল বলেন, 'এখন প্রচুর সময় নষ্ট হয়।'
ট্রিপের সংখ্যা কমে যাওয়ায় চালক ও সাহায্যকারীদের আয় কমে গেছে।
ট্রাকচালক মোহাম্মদ মনির বলেন, 'আগে আমরা প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০-২৫টি ট্রিপ দিতে পারতাম। কিন্তু এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১২-১৫টিতে।'
যান চলাচল ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, প্রতিদিন রাস্তায় ১০টির বেশি যানবাহন বিকল হয়ে যায়। ফলে তাদের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
দায় নিতে রাজি না কেউ:
বিআরটি-৩ প্রকল্পের সড়ক ও মহাসড়ক অংশের প্রকল্প পরিচালক এএসএম ইলিয়াস বলেন, তার অংশের (টঙ্গী-গাজীপুর) রাস্তাগুলো ভালো অবস্থায় আছে। তিনি অবশ্য রাস্তা কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
এএসএম ইলিয়াস বলেন, 'আমি মনে করি শিগগিরই সমস্যাটির সমাধান হয়ে যাবে। কারণ আমরা এখন রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য কাজ করছি। যানজটের সমস্যাটা হচ্ছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অংশে।'
তাদের কাজের কারণে যানজট বেড়ে গেছে স্বীকার করে প্রকল্পের বিবিএ অংশের প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম খান বলেন, রাস্তাটি অনেকদিন থেকেই রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি।
তিনি বলেন, রাস্তাটি এখন বিআরটি-৩ প্রকল্পের আওতায় থাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়কের বিচ্ছিন্ন অবস্থার দিকে নজর দিচ্ছে না। মহিরুল ইসলাম খান আরও বলেন, চুক্তিতে উল্লেখ নেই বলে বিআরটি-৩ ঠিকাদাররা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে না।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, দক্ষ জনশক্তি ও পেশাদারদের অভাবে বাংলাদেশ একটি প্রকল্পও সময়মতো সম্পন্ন করতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ ইন্দোনেশিয়া এমন ১২টি বিআরটি প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।
শামসুল হক আরও বলেন, যানজট নিরসনের জন্য ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কের মতো একটি জাতীয় করিডরকে বাস র্যাপিড ট্রানজিটে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার ভুল করেছে।
তিনি বলেন, 'বিআরটি ওখানে হওয়ার কথা না। এটি (বিআরটি) নির্মাণ করা হয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে। এমনকি রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানেও বিআরটি-৩-এর মতো প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করা হয়নি।'