বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিতে চায় সরকার
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এ বড় ধরণের একটি পরিবর্তন আনতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগে সরকারের পথকে সুগম করবে। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত উচ্চশিক্ষা উদ্যোক্তাদের সমর্থন পাচ্ছে না।
এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে টিউশন এবং অন্যান্য ফি -তে ধারাবাহিকতা আনতে এবং শিক্ষাবিদদের ট্রাস্টি বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে, আইনের কমপক্ষে ১৫ টি ধারা সংশোধন করা হবে বলে জানিয়েছে ইউজিসি সূত্র। এছাড়া, এই পদক্ষেপ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করবে এবং মানসম্মত উচ্চশিক্ষার সুবিধাও নিশ্চিত করবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, "আমরা ইতোমধ্যে খসড়ার ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করেছি, এবং এটি চূড়ান্ত করার জন্য আর দুই থেকে তিনটি বৈঠক প্রয়োজন।"
তিনি আরও বলেন, "এরপর আমরা খসড়াটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠাবো এবং এর বাস্তবায়ন শীঘ্রই হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও সুসংহতভাবে চলতে সাহায্য করা।"
এই সংশোধনী সরকারকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের সুযোগ করে দেবে, যা দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাদে সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান রয়েছে।
ড. চন্দ আরও বলেন, "নিয়োগ প্রক্রিয়ার সুবিধার্থে সরকার প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন সদস্যের একটি প্যানেল চাইবে। এই বিশেষ প্যানেলের মধ্য থেকে অথবা বাইরে থেকে একজন ভিসি নিয়োগ করা হবে।
"এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ভিসিদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা আনতে সাহায্য করবে।"
অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিস অব বাংলাদেশ (এপিইউবি)-এর চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, "সরকারকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের অনুমতি দেওয়া যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ হবে না, কারণ এগুলো বেসরকারি খাত দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।"
ইউজিসি'র এই উদ্যোগের বিষয়ে এমন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, "বরং, ইউজিসি-এর নিজেই আরও আধুনিক হওয়া উচিত।"
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে সুযোগ-সুবিধা, ভালো মানের অবকাঠামো নিশ্চিত না করেই এবং কোন ধরণের প্রবিধান ছাড়াই ফি নিচ্ছে। প্রস্তাবিত সংশোধনী ইউজিসিকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ফি নির্ধারণের সুযোগ করে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে চায়।
তাছাড়া, ট্রাস্টি বোর্ডে শিক্ষাবিদ নিয়োগ বর্তমান আইনে বাধ্যতামূলক নয়। নতুন খসড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ সদস্য নিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে এবং সদস্যের সংখ্যা নয়জন থেকে বাড়িয়ে পনেরো জন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, এই উদ্যোগ উপাচার্যদের শিক্ষক নিয়োগ, অর্থ কমিটি এবং একাডেমিক উন্নয়নের জন্য অন্য যে কোন কমিটির প্রধান হওয়ার ক্ষমতা দেবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মী নিয়োগের জন্য একটি সাধারণ নির্দেশিকা প্রণয়ন করবে ইউজিসি। খসড়াটিতে নিয়ম লঙ্ঘনকে সংজ্ঞায়িত করা হবে এবং নিয়ম ভাঙার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কী ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে তার একটি রূপরেখাও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
বর্তমানে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালযয়ের কার্যক্রম শুরু করার জন্য, কমপক্ষে ২৫ হাজার বর্গফুটের একটি ভাড়া করা ভবন থাকলেই ইউজিসি থেকে আনুমোদন পেতে পারে। কিন্তু খসড়া আইনে এই মাপকাঠি বাড়িয়ে ৩৫ হাজার বর্গফুটের ভবনের কথা বলা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে এপিইউবি'র চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন আরও বলেন, "এখনই আইন সংশোধনের প্রয়োজন নেই; এর পরিবর্তে মন্ত্রণালয় কিছু নিয়ম যোগ করতে পারে। আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাচ্ছি, তাই সরকারের উচিত এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার যাওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে কথা বলা।"
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, পার্লামেন্ট ২০১০ সালে বিদ্যমান যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করেছিল তা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১৫ সালে সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে এপিইউবি নেতাদের প্রতিবাদের মুখে তা ফলপ্রসূ হয়নি।
গত বছরের আগস্ট মাসে মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে আইন সংশোধনের জন্য একটি খসড়া তৈরির নতুন পদক্ষেপ নিতে বলে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থা কী?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এ বলা হয়েছে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ছয়টি বিভাগ থাকতে হবে। কিন্তু ৯১ টি সক্রিয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কমপক্ষে ১৩ টিতে এই নির্দেশনা মানা হয়নি।
বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ক্যাম্পাসগুলো ভাড়া করা ভবন থেকে নিজস্ব স্থায়ী জায়াগায় স্থানান্তর করতেও অনিচ্ছুক বলে জানা গেছে।
গত বছর প্রকাশিত ইউজিসির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধুমাত্র ২৪ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে তাদের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং ১৭ টি আংশিকভাবে উন্নত স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস স্থাপনে কাজ করছে; আরও ২০ টি প্রতিষ্ঠান জমি কিনেছে, কিন্তু স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য এখনও কোন উদ্যোগ নেয়নি। বাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাড়া করা ভবনে তাদের একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউজিসির ৪৫ তম বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ১০৬ টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং এর মধ্যে ৯৪ টি এখন সক্রিয়। কিন্তু সেই সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাত্র ১২ টিতে বর্তমানে প্রয়োজনীয় সংখ্যাক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা রয়েছেন। আর বাকিগুলোয় ৭৯ জন উপাচার্য, ২৪ জন উপ-উপাচার্য এবং ৫৩ জন কোষাধ্যক্ষ রয়েছেন।
ট্রাস্টি বোর্ড, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং অর্থনৈতিক কমিটির নিয়ম অনুসারে সভা অনুষ্ঠীত হওয়া প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাধ্যতামূলক।
কিন্তু চারটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ট্রাস্টি বোর্ডের কোন সভা করেনি, নয়টি সিন্ডিকেটের সভা করেনি, ছয়টি একাডেমিক কাউন্সিলের সভা করেনি এবং ১৪ টি অর্থ কমিটির সভা করেনি।