ভারতে সৈয়দপুরের পুঁটি মাছের শুটকির বিপুল চাহিদা
বাংলাদেশে প্রায় সবগুলো দেশীয় মাছের শুটকি ভারত থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু পুঁটি মাছের ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো ঘটনা। আমদানি নয়, নীলফামারি জেলার সৈয়দপুরের আড়ৎ থেকে বছরে প্রায় দেড়শত ট্রাক রপ্তানি করা হয় ভারতে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধুমাত্র সৈয়দপুর থেকে পুঁটি মাছ রপ্তানি করে ৫০ কোটি টাকার বেশি আয় করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, পাকিস্তান আমলে মাছের শুটকির ব্যবসা নীলফামারী শহরে গড়ে ওঠে। কিন্তু ওই সময়ে সেখানে হঠাৎ করে চুরি বেড়ে যায়। একই সঙ্গে চাঁদাবাজিও শুরু হয়। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীরা সৈয়দপুরের নিয়ামতপুর নামক এলাকায় ১৯৮০ সালে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর সেখানে গড়ে ওঠে সৈয়দপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। এখন রংপুর, নীলফামারী-মহাসড়কের সামনে প্রায় ১৩টি পাইকারি মোকাম ও অর্ধশতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। প্রায় ৫০০ শতাধিক শ্রমিক শুটকি ব্যবসার সাথে সরাসরি জড়িয়ে আছেন।
সৈয়দপুরে বর্তমানে প্রতি কেজি লইট্টা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা কেজি দরে। ফ্যাশা মাছ ৫০০, চ্যালা ৪০০, ছুড়ি ৪০০ এবং ক্ষেত্রবিশেষে পুঁটি মাছের শুটকি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এছাড়া এখানকার মোকামে প্রায় শতাধিক জাতের শুটকি মাছ বিক্রি করা হয়।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, শুটকি ব্যবসায় চট্টগ্রাম দেশের প্রথম স্থানে রয়েছে। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলে তার দ্বিতীয় স্থানে সৈয়দপুর। এখানে চট্টগ্রাম, খুলনা, পাবনা ও বরিশাল, বরগুনা, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন শুটকির মোকাম থেকে সামুদ্রিক ও দেশীয় শুকনা মাছ (শুটকি) আমদানি করা হয়। এরপর এসব মাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান। প্রতি মাসে সৈয়দপুরে শুটকি ব্যবসায় কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়।
তবে সৈয়দপুরের শুটকি ব্যবসায়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে পুঁটিমাছ। দেশীয় প্রজাতির প্রায় সব রকমের শুটকি মাছ ভারত থেকে আমদানি করা হলেও শুধু পুঁটি মাছ রপ্তানি হয় সৈয়দপুর থেকে। আর পুঁটি মাছ রপ্তানি করেই প্রায় ৫০ কোটি টাকার আয় করেন ব্যবসায়ীরা।
সৈয়দপুরে প্রতি মাসে শতশত ট্রাক শুটকি দেশ ও বিদেশ থেকে আনা হলেও মোট কতো টাকা বিক্রি হয় এমন তথ্য ব্যবসায়ীদের কাছে নেই। তবে বাংলা কার্তিক মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ভরপুর ব্যবসা থাকে এই বাজারে। এই সময়ে প্রতিদিন এই বাজারে গড়ে কয়েক লাখ টাকার শুটকি বিক্রি হয়। অন্য সময়ে সাধারণত শুটকি আমদানি করে ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেন। পরে বিক্রি করেন চাহিদামতো। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে দেশীয় পুঁটি মাছের উপর ঝোঁক বেশি অনেকের।
সৈয়দপুরের শুটকি ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মোকামে প্রতিবছর ভারতে অন্তত ১২০ ট্রাক শুটকি রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে প্রধান মেসার্স বিসমিল্লাহ মার্কেট। এ ছাড়া মেসার্স লাকি এন্টারপ্রাইজ, শেখ এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স মাসুদ আলী ভারতে পুঁটি মাছ রপ্তানি করেন।
এই মোকামে শুটকি মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে জেলায় করদাতার তালিকায় তৃতীয় হয়ে বিশেষ সম্মাননা পেয়েছেন মেসার্স বিসমিল্লাহ মার্কেটের মালিক মো. শাহাবুদ্দিন মিয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে গত বছরে শ্রেষ্ঠ করদাতাও হয়েছেন তিনি। এই বন্দর দিয়ে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে পুঁটি মাছ (শুটকি) রপ্তানি করেন তিনি।
প্রবীণ এই ব্যবসায়ী বলেন, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে মাছের দাম কম। এ কারণে সেখানে মাছ শুটকি করে বিভিন্ন দেশে তারা ব্যবসা করে। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে তাদের কাছ থেকে টেংরা, শিং, পাবদা, চ্যালাসহ বিভিন্ন জাতের মাছ আমদানি করা হয়। সৈয়দপুরের ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর শতশত কোটি মাছ ভারত থেকে আমদানি করে।
শাহাবুদ্দিন বলেন, মেসার্স বিসমিল্লাহ প্রতি বছর প্রায় ১০০ গাড়ি (ট্রাক) পুঁটি মাছের শুটকি ভারতের সেভেন সিস্টারস অঙ্গরাজ্যে রপ্তানি করছে। বাংলাদেশের পুঁটি মাছের চাহিদা সেখানে ক্রমাগত বাড়ছে।
মেসার্স বিসমিল্লাহ মার্কেটের ব্যবস্থাপক বিজন কুমার মহন্ত জানান, আমরা প্রতি বছর অন্তত ২৫ কোটি টাকার মাছের ব্যবসা করি। এর মধ্যে সাগরের লবণাক্ত পানির মাছ বেশি রয়েছে। এগুলো সাধারণত দেশের মধ্যেই বিক্রি হয়। এখান থেকে সারাদেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে মাছ কিনে নিয়ে যান। তবে বিভিন্ন মোকাম বা জেলা থেকে পুঁটি মাছ কিনে এনে ভারতে বিক্রি করা হয়। প্রতি ট্রাক পুঁটি মাছের শুটকি গড়ে ৪৫ লাখ টাকা করে বিক্রি হয়। এ হিসেবে মেসার্স বিসমিল্লাহ মার্কেট থেকে প্রতি বছর ৪৫ কোটি টাকার শুটকি ভারতে আমদানি করা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকেই নিয়ামতপুর এলাকায় শুটকির ব্যবসা করে আসছে মেসার্স লাকি এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মো. শরিফ মিয়া। তিনি বলেন, দেশব্যাপী চট্টগ্রাম, কক্সবাজরের মাছের চাহিদা বেশ ভালো। এরপর পাবনা ও নাটোরের চলনবিলের শুটকি মাছ বেশি বিক্রি হয়। এই আড়তে গড়ে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করা হয়। তবে ভারতে পুঁটি মাছ আমদানিও করা হয়। কিন্তু বেশি পরিমাণে নয়।
সৈয়দপুর শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার শুঁটকির আড়ত। এখানেই মেসার্স মুন্সি মাকের্ট। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মিল্টন হোসেন বলেন, মাছ ব্যবসায় সৈয়দপুর সারা দেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। কিন্তু সমস্যাও আছে এখানে। যেমন আমদানি করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সাধারণভাবে সংরক্ষণ করতে গেলে পোকা ধরে যায়। নষ্ট হয়ে যায় অনেক মাছ। অনেক সময় এসব মাছ গুঁড়া করে ফিড হিসাবে বিক্রি করা হয়। তখন ব্যবসায়ীরা অনেক লোকসানে পড়েন। এ কারণে এই মোকামে একটি শুটকি মাছ হিমাগার দরকার। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নিতে হবে।
এখানে শুটকি মাছ ব্যবসায়ীদের দুটি সমিতি রয়েছে। একটি শুটকি মাছ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির। অন্যটি খুচরা দোকানদাররা মিলে গড়ে তুলেছেন 'নিয়ামতপুর শুটকি মাছ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড'। এই প্রতিষ্ঠানে সভাপতি বাসেদ আলী বলেন, এখানে মাছ ব্যবসা জমজমাটই ছিল। কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। মাছ মজুদ করে ধরা খেয়েছে। বিষয়গুলো বিবেচনা করে সরকারি প্রণোদনা দেওয়া দরকার।
সৈয়দপুর শুটকি মাছ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, অন্যান্য মাছ আমদানি করা হলেও চাহিদার কথা বিবেচনা করেই সৈয়দপুর মোকাম থেকে অন্তত ৫০ কোটি টাকার উপরে পুঁটিমাছ রপ্তানি করা হয়।
সৈয়দপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সানী খান মজলিস বলেন, উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বড় শুটকি মাছের আড়তে বছরে কমপক্ষে সাড়ে ৪ হাজার টন মাছ বিক্রি হয়। আমদানি নির্ভর মাছের বাজারে সুখের খবর হচ্ছে, সৈয়দপুর থেকে কয়েক কোটি টাকার পুঁটি মাছ রপ্তানিও করা হয়। তবে করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারিভাবে তাদের ৪ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
শুটকি মাছ সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম হুসাইন বলেন, মাছ সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে দেশের কোথাও হিমাগার নেই। এই কারণে সরকারিভাবে এখানে হিমাগার করার সুযোগ নেই। তবে বেসরকারিভাবে কেউ করতে চাইলে তাকে সহযোগিতা করা হবে।