নির্বাচনে শতভাগ ভোট নিশ্চিত করার ফর্মুলা
প্রতিটি নির্বাচনই কম-বেশি তর্ক-বিতর্কের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জাঁদরেল বুদ্ধিজীবী, সবাই যার যার মতো শুরু করেন চুলচেরা বিশ্লেষণ। সদ্য সমাপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও এর ব্যতিক্রম নয়। ভোটার উপস্থিতি চোখে লাগার মতো কম হওয়ায় এই নিয়ে বাজার শুধু গরমই নয়, বরং রীতিমতো আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে, চাই বা না চাই, এর আঁচ আমাদের গায়ে লাগছেই।
বিতর্ক ও বিশ্লেষণ চলছে, চলুক! এই ফাঁকে চলুন আমরা বিশ্ব ইতিহাসে চোখ রেখে ‘অসাধারণ’ কিছু নির্বাচনের খবর জেনে নিই।
ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া এক অনন্য মডেল হাজির করেছে ! গত বছর দেশটির সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল এই মডেলে পেয়েছে শতভাগ সফলতা। সেই নির্বাচনে সবাই ভোট দিয়েছে এবং সেই সমস্ত ভোট পড়েছে ক্ষমতাসীন দলেরই পক্ষে! কিভাবে এমনটা হলো?
নির্বাচনের আগে উত্তর কোরিয়ার সরকার ১৭ বছরের বেশি বয়সী প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক করে। ভোট না দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়ায় যেন নির্বাচনের দিন অসুখে ভোগাও বারণ দেশটির জনগণের! তাই শতভাগ ভোটও পড়ে প্রতি নির্বাচনে। এর চেয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা আর কি হতে পারে?
কিন্তু মজাটা অন্য জায়গায়। নিয়ম অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সের উপরে প্রত্যেক নাগরিক ভোটের দিন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছেন। তবে দেশটির সরকার ভোটারদের প্রতি অনেক ‘যত্নশীল’ ছিল। ভোটারদের কিচ্ছু করতে হয়নি, কষ্ট করে ব্যালট পেপারে সিলটাও মারতে হয়নি! কেননা ব্যালট পেপারে শুধু একজন প্রার্থীরই নাম ছিল- সরকার দলীয় প্রার্থীর। ভোটাররা কেন্দ্রে গেছেন, ব্যালট পেপার নিয়েছেন, ভাঁজ করে ফেলেছেন বাক্সে। ব্যস হয়ে গেল ভোট দেওয়া।
শুধু তাই নয়, ভোট দেওয়ার পর ভোটারদের জন্য আনন্দ উদযাপনেরও ব্যবস্থা ছিল। কেন্দ্র থেকে বের হয়ে সবাই ‘আনন্দ মিছিলে’ যোগ দিয়েছেন। উপায় কি? রঙিন ফেস্টুন, পোস্টার হাতে রং ঝলমলে এই সমস্ত র্যালিতে যোগ দেওয়াও যে সেখানে বাধ্যতামূলক! এ সময় খুশি না হলেও জোর করে হাসতে হবে আপনাকে। মাইকেল মধূসুদন দত্ত বেঁচে থাকলে ‘অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক’ এই নির্বাচন দেখে হয়তো লিখে ফেলতেন ‘একেই কি বলে গণতন্ত্র?’
আর শুধু উত্তর কোরিয়া কেন, বাংলাদেশও কম কিসে? এমন নির্বাচনের নজির তো আমাদেরও আছে। মনে করে দেখুন জেনারেল আইয়ুব খান, জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদের আমলের ‘হ্যাঁ – না’ ভোটের কথা।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখলের পর আইয়ুব খান 'মৌলিক গণতন্ত্র’ চালু করেন। এই পদ্ধতিতে ১৯৬০ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে নির্বাচিত হন ৮০ হাজার কাউন্সিলর।
তারপর আইয়ুব খান ‘হ্যাঁ- না’ ভোটের আয়োজন করেন। সে নির্বাচনে আইয়ুব খানই একমাত্র প্রার্থী। নির্বাচনে শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি ভোট পেয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি; আর নিজেকে পাকিস্তানের বৈধ রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
আইয়ুবের ফর্মুলা জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদও অনুসরণ করেছেন। তারাও সাফল্য পেয়েছেন, অবধারিতভাবেই। ১৯৭৭ সালে ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে জিয়া ছিলেন একমাত্র প্রার্থী। তখনকার নির্বাচন কমিশন থেকে দাবি করা হয়, ভোট পড়েছে শতকরা ৮৫ ভাগ; অথচ জেনারেল জিয়া পেয়েছেন ৯৯.৫ শতাংশ ভোট! ফলাফল- রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের ওপর জনগণের অগাধ আস্থা আছে বলে দাবি করেন জেনারেল জিয়া।
জেনারেল এরশাদও কম যাননি। ১৯৮৫ সালের ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে তার পক্ষে ৯৫ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন জানায়। সে নির্বাচনেও এরশাদ ছিলেন একমাত্র প্রার্থী। ফলাফল- জনগণের রায় এরশাদের পক্ষে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের আসন এভাবে আরেকটু পাকাপোক্ত করে নেন তিনি।
তবে খালি চোখে বোঝা যায়, জেনারেল জিয়া এবং এরশাদের 'হ্যাঁ-না’ ভোটে বিপুল কারচুপি হয়েছিল। সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল জেনারেলদের পক্ষের লোকজন।
সুতরাং ইতিহাসই সাক্ষ্য দিচ্ছে, নিজের পক্ষে শতভাগ ভোট প্রদানের মডেলের আবিষ্কারক হিসেবে উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং-উন একক কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন না। জেনারেল আইয়ুব খান, জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ এমন মডেল নির্বাচন অনেক বছর আগেই প্রয়োগ করে সাফল্য দেখিয়েছেন। তাই বিশ্বের নির্বাচনের ইতিহাসে এমন হঠকারিতার উত্তরসূরি হিসেবে রীতিমতো গর্ব করতে পারি আমরা!