‘যে দেশে স্বাধীনতার পর থেকে আইনের শাসন একটা স্ট্রাগল করছে, সেখানে তো প্রচুর গল্প আছে’
কলকাতার জনপ্রিয় পরিচালক সৃজিত মুখার্জি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম 'হৈ চৈ'য়ের জন্য নির্মাণ করেছেন 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি' নামে একটি সিরিজ। জি ফাইভের জন্য বাংলাদেশে তরুণ নির্মাতা তানিম নূর ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় যৌথভাবে নির্মাণ করেছেন 'কন্ট্রাক্ট' নামে আরও একটি সিরিজ।
দুটি সিরিজই নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশি লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের লেখা দুটি উপন্যাস থেকে।
মৌলিক থ্রিলার গল্পের জনপ্রিয় লেখক তিনি। একইসঙ্গে নিজের প্রকাশনা থেকেও নতুন লেখকদের বই প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
নিজের লেখালেখি, প্রকাশনা ও থ্রিলার গল্পের নানা দিক নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের (টিবিএস) সঙ্গে কথা বলেছেন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।
টিবিএস: যতদুর জানি, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখানে এক বছর পড়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। চারুকলা বাদ দিয়ে সাংবাদিকতায় পড়ার আগ্রহ কেন হলো এবং আপনি সাংবাদিকতায় পড়েও সাংবাদিক না হয়ে লেখক হয়ে গেলেন কেন?
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: আমি আসলে আর্টিস্ট হতে চেয়েছিলাম অথবা মিউজিশিয়ান। লেখালেখি আমার জীবনের লক্ষ্যের চার নম্বরে ছিল। চারুকলায় ভর্তি হয়েছিলাম আর্টিস্ট হতেই। কিন্তু ১৯৯৩ সালে যখন ভর্তি পরীক্ষার ভাইবা দিলাম, তখনকার অভিজ্ঞতাটা খুব বাজে ছিল। যারা ভাইবা নিচ্ছিলেন, মানে ওই সময়ের টিচাররা আমার সঙ্গে খুবই বাজে আচরণ করেছিলেন। আমি তাদের নাম বলতে চাই না; তবে তারা খুবই বিখ্যাত আর্টিস্ট। তাদের আচরণ আমার কাছে খুবই অবমাননাকর মনে হয়েছিল।
আমি খুবই সংবেদনশীল মানুষ। তাই ওই অপমান মেনে নিতে পারিনি। অপমান করলেও তারা ঠিকই আমাকে ভর্তি পরীক্ষায় টিকিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার সমস্যা হলো ক্লাসে গিয়ে। যারা অপমান করেছেন, তারাই যখন ক্লাস নিতে এলেন, তখন আর মেনে নিতে পারলাম না। তাদের জন্য বহুদিন আমি ক্লাস করিনি। চারুকলার উল্টোদিকে ছবির হাট ও মোল্লার দোকানে বসে থাকতাম। পরের বছর সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম। চারুকলা ছাড়ার এটাই মূল কারণ।
আর সাংবাদিকতায় না থাকারও একটা কারণ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছি। 'ইত্তেফাক'সহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় কাজ করেছি। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমার উপলব্ধি হলো, আমি যে স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে চাই, পত্রিকা জগতে সেটা পাব না। সামনে হয়তো আরও খারাপ হবে। তাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
অবশ্য, তারও আগে ওইটুকুন বয়সে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কখনো চাকরি করব না; চাকরি দেবো। বয়সের কারণে নিজের মধ্যে একটা 'পাকনামি' ভাব চলে এসেছিল!
টিবিএস: ২০০৩ সালে আপনি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'বাতিঘর' চালু করেন। তারও আগে পাশ করে বের হয়েছেন। মাঝের সময়টুকু কী করেছেন তখন?
নাজিম উদ্দিন: আমি যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাশ করে বের হই, সেদিনই সিদ্ধান্ত নিই সাংবাদিকতা করব না। লেখালেখি শুরু করব। তখন বাংলাবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করি। লেখা দিই। কিন্তু তারা কেউই নতুন লেখকের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখান না। এক রকম অবজ্ঞা করেন। মাঝের সময়টুকুতে বই প্রকাশের চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছি। আসলে তখন পরিবার থেকেই খুব বেশি চাপ ছিল না। তাই নিজের স্বাধীনতা ছিল।
বাবা মারা গেছেন আমার ছোটবেলায়। আমরা পাঁচ ভাই-বোন। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। যৌথ পরিবার। সবাই মিলে-মিশে থাকি। আলাদা করে কিছু করলাম কি না, সে রকম কোনো বিষয় কেউ অতটা খেয়াল করত না।
টিবিএস: বলা হয়ে থাকে, আপনি এ দেশের প্রথম মৌলিক থ্রিলার লেখক। আপনার কী মত?
নাজিম উদ্দিন: একটা সময় এ দেশে অ্যাডাপটেশন অনুবাদ প্রচুর বিক্রি হতো। আমিও প্রচুর বই পড়তাম। ওই সময় ওই থ্রিলারগুলোই পড়া হতো। আমি যখন কলেজে পড়ি, তখনই উপলব্ধি করি, এ দেশে আসলে মৌলিক থ্রিলার নেই। তখন আমি সিনেমাও দেখতাম খুব। অনেক থ্রিলার উপন্যাস পড়তে গিয়ে আবিস্কার করলাম, এটার কাহিনি তো আমি জানি। কারণ ততক্ষণে ওই উপন্যাস নিয়ে নির্মিত সিনেমা দেখে ফেলেছি।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, সিনেমাগুলো অনেক আগের। আর বইগুলো সিনেমা থেকে অ্যাডাপটেশন। তখনই অনুভব করেছি, আমরা কেন নিজেদের গল্প লিখি না? যে দেশে স্বাধীনতার পর থেকে আইনের শাসন একটা স্ট্রাগল করছে, সেখানে তো প্রচুর গল্প আছে। শুধু পত্রিকা ফলো করলেই তো অনেক গল্প পাওয়া যায়।
যখন লেখালেখি শুরু করি, তখনই ভেবে নিই, মৌলিক থ্রিলার গল্প নিয়ে কাজ করব। কারণ, এই সেক্টরটা খালি আছে। প্রথম কি দ্বিতীয়- এসব ভাবিনি।
টিবিএস: আপনার প্রথম উপন্যাস 'নেমেসিস'। এটার গল্পটা কীভাবে মাথায় এলো?
নাজিম উদ্দিন: এটা আসলে বলা কঠিন। লেখা তো নাজিল হওয়ার জিনিস। হঠাৎ করেই মাথায় এসেছে। 'নেমেসিস'-এর পরে এটার সিকুয়েল ও পিকুয়েল উপন্যাস লিখেছি। মৌলিক থ্রিলার হিসেবে 'নেমেসিস' যখন এলো, তখন অন্যান্য পাবলিশার ও লেখকদের মাঝে খুব নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। সবাই বলাবলি করে, আমার এটা অনুবাদ করে লেখা। পরে সবার ধারণা বদলে যায়। বইটাও পাঠকদের মাঝে খুব সাড়া ফেলে।
টিবিএস: আপনার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা কত?
নাজিম উদ্দিন: এখন অবধি ১১টি থ্রিলার উপন্যাস বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আরও তিনটি উপন্যাস ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে মানুষ আমাকে পরে চিনেছে, আগে কলকাতার মানুষ চিনেছে। এ দেশের মানুষ বেশি চিনেছে ২০১৮ সালে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় যখন ঘোষণা দেন, আমার উপন্যাস নিয়ে তিনি সিরিজ করবেন, তখন এবং সিরিজটি হওয়ার পর।
টিবিএস: সৃজিতের সঙ্গে প্রথম আলাপের ঘটনা মনে আছে?
নাজিম উদ্দিন: হ্যাঁ। আমি তার একটা ভিডিও ইন্টারভিউ দেখেছি, যেখানে তিনি 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি' নিয়ে সিরিজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরে, ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রয়ারি তিনি আমাকে ফোন করেন। জানান, উপন্যাসটা নিয়ে সিরিজ করবেন। তার ঠিক তার কিছুদিন আগে কলকাতার আরেক প্রযোজককে এটার স্বত্ব দিয়ে এসেছি। সৃজিত এটা জেনে তার নাম জানতে চান। জানার পর তিনি বলেন, 'আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি।' ঠিকই তিনি ম্যানেজ করে নিয়েছেন। নিজেই সিরিজটা বানিয়েছেন।
টিবিএস: দুটি উপন্যাস থেকে সিরিজ হয়েছে। কোনটা কেমন লেগেছে?
নাজিম উদ্দিন: আমার কাছে মনে হয়েছে সৃজিত কাজটার প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন। তার নির্মাণ দেখে খুব ভালো লেগেছে। আসলে বই থেকে সিরিজ বা সিনেমা বানানোর সমস্যা হলো, উপন্যাস পড়ার পর চরিত্রগুলো একেক পাঠক একেকভাবে কল্পনা করেন; এ কারণে অনেকের কাছে ভালো লাগে, অনেকের কাছে লাগে না। এটা হতেই পারে। তবে 'কন্ট্রাক্ট' সিরিজটি আমার ভালো লাগেনি। আমি খুব হতাশ হয়েছি। আমি পুরাটা দেখে শেষও করতে পারিনি।
টিবিএস: আপনার সঙ্গে নিশ্চয় কলকাতা ও বাংলাদেশের পরিচালকেরা যোগাযোগ করেন?
নাজিম উদ্দিন: হ্যাঁ, অনেকেই যোগাযোগ করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, কলকাতা থেকে যারা যোগাযোগ করেন, তারা নির্দিষ্ট উপন্যাস নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু আমাদের দেশের ডিরেক্টররা সেসবের ধার ধারেন না। বলেন, 'ভাই, আপনার কাছে কী মনে হয়? কোন উপন্যাস দিয়ে সিরিজ বানালে দর্শক পছন্দ করবেন?' এটা তো আমার বলার কথা না। পরিচালক, প্রযোজক এটা চূড়ান্ত করবেন। তারপর লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এ কারণে আমার মনে হয়, কলকাতার ডিরেক্টররা পড়াশোনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ ডিরেক্টর পড়াশোনা করেন না। যা কিছুই করেন, পড়াশোনাটা খুব দরকার।
টিবিএস: লেখকদের সম্মানী বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
নাজিম উদ্দিন: সম্মানীর বিষয়ে আমার ভালো ও খারাপ- দুই অভিজ্ঞতাই আছে। আমাদের দেশে তো সম্মানী দেওয়ার অভ্যাসই নাই! এ দেশে অভ্যাসটা হলো, 'আপনার গল্প নিয়ে কাজ করব, এতেই আপনি ধন্য হয়ে যাবেন। আবার সম্মানী!'
খেয়াল করে দেখবেন, বেশিরভাগ ডিরেক্টর নিজেই গল্প লিখেন। তাদের কাছে গল্প বা চিত্রনাট্য লেখা কোনো কাজই না। এ কারণে এই দেশের মিডিয়ার এই গতি। যতদিন লেখকদের যথাযোগ্য সম্মান ও সম্মানী না দেওয়া হবে, ততদিন এই ইন্ড্রাস্ট্রি দাঁড়াবে না।
এই দেশে আমাকে যে পরিমান সম্মানী অফার করা হয়েছে, সেটা কলকাতায় থেকে পাওয়া ছয় ভাগের এক ভাগ। অথচ অফারের সময় প্রযোজক বলছেন, 'আপনাকে এই দেশের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মানী দিলাম।'
টিবিএস: নতুন লেখকদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
নাজিম উদ্দিন: আমি সবসময় তাদের পক্ষে। আমি তো তাদের কষ্টটা জানি। আমি সেই অবজ্ঞার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। তাই যেকোনো নতুন লেখককে আমার প্রকাশনীতে স্বাগত জানাই। কারণ, নতুন লেখকেরা খুবই ভালো করছেন। দুঃখজনক হলো, আমাদের এখানে বেশিরভাগ প্রকাশক নতুন লেখকদের পাণ্ডুলিপি পড়েন না। বোঝেনও না হয়তো। তাই তারা নতুনদের নিয়ে ঝুঁকি নিতে চান না।
টিবিএস: আপনার লেখালেখি নিয়ে পরিবারের মানুষ কী বলেন?
নাজিম উদ্দিন: তারা কিছুই বলেন না! আমিও এসব আসলে কিছু বলি-টলি না। পরিবারের সবাই ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এমনকি আমার এলাকাতে খুব বেশি মানুষ জানে না, আমি লেখালেখি করি। সবাই জানে, আমি বইয়ের ব্যবসা করি।
আমার মা মারা গেছেন কিছুদিন হলো। আমার জন্য আনন্দের বিষয় হলো, তিনি জেনে গেছেন, আমি লেখালেখি করি।