‘ডার্টি ফিড’ বন্ধ হলো, ভবিষ্যৎ ‘ক্লিন’ তো?
আগে থালাবাটি অ্যান্টেনার সাথে লাগিয়ে ভারতের টিভি চ্যানেল দেখার চেষ্টা করতো বাংলাদেশের মানুষ। ঝিরঝির দূরদর্শনে মহাভারত ও বাংলা গানের আসর অনেকেই তখন নিয়মিত দেখতেন। দেশের সীমান্তবর্তী মানুষেরা অতিরিক্ত কসরত ছাড়াই ভারতীয় বাংলা চ্যানেল দেখার সুযোগ পেতেন।
তবে প্রায় দুই যুগ আগে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মানুষ ঝিরঝির ছাড়া, পরিষ্কার পর্দায় বিদেশি চ্যানেল দেখা শুরু করে। প্রথমে মার্কিন সংবাদ ভিত্তিক টিভি চ্যানেল সিএনএনের সরাসরি সম্প্রচার শুরু হয় বিটিভিতে, সকালে তিন ঘন্টার জন্য। এরপর ধীরে ধীরে ডিশ অ্যান্টেনার কল্যাণে ভারতীয় থেকে রুশ, সৌদি থেকে ফরাসি সকল ধরনের টিভি চ্যানেলের জানালা খুলে যায় এদেশের মানুষের জন্য, দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা। এসব চ্যানেলে হাজারো রকম বিচিত্র অনুষ্ঠান দেখে মানুষ দৃশ্যমাধ্যম সম্পর্কে একদিকে যেমন আলোকিত হতে থাকে, তেমনি এদেশেও নানা ধরনের টিভি চ্যানেল না থাকার অভাব অনুভব করতে থাকে।
এখন বাংলাদেশে ৩০টি বেসরকারি ও ৩টি সরকারি টিভির সম্প্রচার হয়, আর বিদেশি চ্যানেল চালু ছিল শতাধিক। সম্প্রতি সরকারি নির্দেশনা মেনে বিদেশী চ্যানেল, যেগুলো ক্লিন ফিড দিচ্ছে না, সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। বিজ্ঞাপন ছাড়া অনুষ্ঠান যদি ক্লিন ফিড হয়, তাহলে বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান ফিডকে ডাকা যায় 'ডার্টি ফিড' হিসেবে।
এখন এই 'ডার্টি ফিডে'র বিরুদ্ধে অভিযোগটা কিন্তু আজকের নয়, বহুদিন ধরেই। অর্থাৎ অনেকেই নানা সময়ে বলে আসছিল, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি বাজার দখলের কাজটাও সেড়ে নিচ্ছে এই 'ডার্টি ফিড', এতোদিনে অবশ্য দখলে ষোলকলা পূর্ণ হয়ে গেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে কথা! বিদেশী, বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলে যেসব পণ্যের বিজ্ঞাপন ভেসে আসতো, সেসব পণ্য ঢাকার বাজার সয়লাব বহু আগে থেকেই।
কিন্তু হঠাৎ করে কেন এই ক্লিন ফিড পাওয়ার জন্য আকুতি? এর কারণ হলো বেসরকারি টিভি মালিকদের সংগঠন (অ্যাটকো) খেয়াল করল বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে বিদেশে।
এর কারণ এদেশের মানুষ বিদেশের চ্যানেলই বেশি দেখে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এর কারণ তো বটেই, পাশাপাশি দেশীয় চ্যানেলগুলোর মানসম্মত অনুষ্ঠান তৈরি করতে না পারাও এরজন্য দায়ী কম নয়। তো দশকের পর দশক ধরে একটি সংস্কৃতিতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠল, সে ফাঁকে দেশের বাজার দখল হলো এবং দেশীয় মুৎসুদ্দিদের আমরা দেখলাম মহোৎসবে বিদেশী পণ্যে ছেয়ে ফেলল বাংলাদেশের বাজার, ওদিকে বগল বাজাল বিদেশী পুঁজিপতিরা।
এখন যখন জাতীয় টিভি কারখানার পুঁজিপতিরা লক্ষ্য করল, আরে সব বিজ্ঞাপন তো বাইরে চলে যাচ্ছে, দেশের টিভিতে বিজ্ঞাপন কম আসছে, টান পড়ছে আয় রোজগারে, তখন তাদের টনক নড়ল। এর আগে কিন্তু এটি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, কেউ পাত্তা দেননি, যখন নিজেদের পকেটে টান পড়ল, তখন বোধদয় হলো।
তো দেশীয় টিভি মালিকদের সংগঠনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকারি নির্দেশনা জারি এবং সেই মোতাবেক যে 'ডার্টি ফিড' বন্ধ হলো সেটা মন্দ হয়নি। দেশের টাকা আর বাইরে যাবে না। দেশের টাকা দেশে রাখতে ও নিজেদের টিভি বাঁচাতে এই উদ্যোগ ভালো।
কিন্তু আমাদের মেরুদণ্ড বাঁচাবে কে? নাকি সেটার জন্যও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একাট্টা হতে হবে? বলছিলাম, লোকে তো শিক্ষাকেই জাতির মেরুদণ্ড বলে, তাই শিক্ষা যে আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে সেটা খেয়াল করছেন না? শিক্ষা কি বাজার রক্ষার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? বাংলাদেশি বাবা-মায়ের ঘরে ঘরে এখন 'ইংরেজ' ছানাপোনা, তারা বাংলা বোঝে না। তো দেশী বাংলা চ্যানেল দেখবে কে?
দেশের যেসব চ্যানেল বাঁচানোর জন্য সরকারি নির্দেশনা, সেই নির্দেশনা, শিক্ষায় নজর না দিলে ভবিষ্যতে কার্যকরী থাকবে তো?
ধরুন এখন তো বিশাল সংখ্যক ছেলেমেয়ে বাংলা পড়তেই পারে না। বাংলা ভাষার অনুষ্ঠানও তাদের ভালো লাগে না। তারা ইংরেজিকেই বেশি নিকট বলে বোধ করে। বাঙালি 'ইংরেজ'দের সংখ্যা বাড়ছে, যেহেতু ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে সরকারের সায় আছে, তাই একুশের চেতনা-টেতনা সরিয়ে রেখে লোকে এখন ইংরেজিকেই পুজো করে। তো এই পূজারীরা আপনার দেশের বাংলা চ্যানেল বহু আগেই দেখা ছেড়ে দিয়েছে। গোড়া ঠিক করতে হবে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে আগে জাতীয় নীতি নির্ণয় করতে হবে। শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম যদি মাতৃভাষায় করা যায় তাহলে শুধু দেশীয় টিভি চ্যানেল নয়, দেশের প্রকাশনা শিল্প, পত্র-পত্রিকা সবই নতুন করে আশার আলো দেখবে।
ইদানিং যেভাবে নানা আইনকানুনের মাধ্যমে ব্যক্তির কথা বলার পথ সংকুচিত হয়ে আসছে, সেরকম সময়ে ক্লিন ফিডের কথা বলে বিদেশী চ্যানেল বন্ধ করে দেয়াকে অনেকেই হয়তো সন্দেহের চোখে দেখবেন। বিদেশী বিজ্ঞাপন রুদ্ধ করার উদ্যোগটি ভালো, তবে এর উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে অনেকের মনেই শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা দানা বাঁধতে পারে। এই শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা দূর করে স্বচ্ছ ধারণা দান করার দায়িত্ব সরকারেরই, পাশাপাশি আগ্রাসনের ক্ষেত্রে শুধু বাজার নয়, মগজের আগ্রাসনের ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা থাকা ও সেই অনুযায়ী কাজ করা তাদের দায়িত্বের ভেতরেই পড়ে। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলছিলাম।
আর যদি ধরুন, ক্লিন ফিড দিতে অস্বীকৃতি জানাল বিদেশি চ্যানেলগুলো, তাহলে কি সেগুলো বন্ধই হয়ে যাবে চিরতরে? যখন সময় ছিল তখন বন্ধ করা হয়নি, এখন আর আসলে এভাবে বাজার দখলমুক্তও করা যাবে না। বিদেশী চ্যানেল বন্ধ করে দিলেও, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এখন হাতের মুঠোয়। অঞ্চল ও লিঙ্গ লক্ষ্য করে ফেসবুকে পণ্যের প্রচারণা চালানো যায়। কাজেই মুক্তবাজারের নামে যেভাবেই হোক বিদেশি পণ্য এদেশে ঢুকবেই।
এছাড়া দেশীয় বিজ্ঞাপন এখন গুগল, ইউটিউব ও ফেসবুকেও যাচ্ছে, সেগুলো তো আর বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাই, ক্লিন ফিডের জন্য চাপ অব্যাহত রেখে যদি দেশের টিভিগুলো ভালো মানের অনুষ্ঠান বানাত, তাহলে বরং কাজের কাজ হতো।
এমনিতেও মানুষ টিভি দেখা ছেড়েই দিয়েছে প্রায়; যাও দর্শক কিছুটা খবর, বিনোদন ও খেলা দেখে টিভিতে, এখন যদি এভাবে বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে মানুষ, কথার কথা বলছি, স্টার মুভিজের 'অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেমে'র ফাঁকে যেমন বিটিভির 'বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনে'র খবর দেখত, এখন হয় তো সেটাও দেখবে না, কারণ টিভি সেটের সামনে বসার সে আর উৎসাহই পাবে না।
আর মানুষ যদি টিভির সামনেই না বসে তাহলে বিজ্ঞাপনদাতারাও আর উৎসাহ পাবে না দেশীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে। তারা হয় তো সেক্ষেত্রে বিদেশি সার্চ ইঞ্জিন ও সামাজিক যোগাযোগকেই বেশী গুরুত্ব দিতে শুরু করবে। কাজেই যা করা হচ্ছে, তার প্রতিক্রিয়ায় ভবিষ্যতে কি হতে পারে, সেটা ভেবে নেয়াটাও জরুরি।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক