বগুড়ায় রানার প্লাজার ফুডকোর্ট: সম্ভাবনার ব্যবসায় শঙ্কার ছাপ
বগুড়া শহরের একমাত্র শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেট রানার প্লাজায় নারী ব্যবসায়ীদের 'দখলে থাকা' ফুডকোর্ট সম্ভবনাময় ছিল। কিন্তু প্রায় বছরব্যাপী করোনা এই সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে। সম্ভবনাময় এই ব্যবসা অনেকের কাছে এখন শঙ্কায় পরিণত হয়েছে। কারণ, লকডাউন ও সরকারি বিধিনিষেধের ফলে অনেক ব্যবসায়ী এখন ঋণে জর্জরিত হয়েছেন। এমন সংকটে কেউ কেউ ব্যবসাই ছেড়ে দিয়েছেন।
উত্তরবঙ্গের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র বগুড়ায় প্রায় শতাধিক হোটেল রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে একমাত্র শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত রানার প্লাজার সাততলায় ১৭টি রেস্টুরেন্ট মিলে গড়ে উঠেছে ফুডকোর্ট। রেস্টুরেন্টগুলোতে হায়দরাবাদের বিরিয়ানি, কাচ্চি বিরিয়ানি, দই-ফুচকা, গ্রিল নানরুটি, বার্গার, নাচোস, স্যুপ, চওমিন, অন্থন, কফি থেকে শুরু করে সব চাইনিজ খাবার পাওয়া যায়।
এখানকার বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টের মালিক নারী। পরিচালনাও করেন তারা। ফুডকোর্টের দোকানগুলো ছোট ছোট। এ কারণে ক্রেতাদের বসার জন্য বাইরে চেয়ার সাজানো রয়েছে। বাইরের চেয়ার বা টেবিল কোনো দোকানের নির্দিষ্ট হয়। খাবার খেতে আসা লোকজন যার যেখানে ইচ্ছে বসতে পারেন। করোনার আগে এই মার্কেটে প্রচণ্ড ভিড় থাকলেও এখন এখানে লোকজন নেই বললেই চলে। ফলে ফুডকোর্টের ব্যবসায়ীরা স্ট্যাফদের খাবার, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ জোগাতে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন।
বগুড়া শহরের মালতিনগরের বাসিন্দা তাহমিনা পারভীন শ্যামলী। ফুডকোর্ডের তার রেস্টুরেন্টের নাম দিয়েছেন ম্যান্ডোলিন ক্যাফে। ব্যবসায়ী বাবা তাইফুল ইসলাম তোহার হাত ধরেই শামলীর রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় হাতেখড়ি। শ্যামলী বলেন, বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার সপ্তপদী মার্কেটের তৃতীয় তলায় ১৯৮৯ সালে তার বাবা প্রথম চাইনিজ রেস্তোরাঁ চালু করেন। বাবা মারা যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাবার স্মৃতি ধারণ করে রানার প্লাজায় ২০১৭ সালের দিকে ম্যান্ডোলিন ক্যাফে চালু করেন তিনি। এখানে শুরুটা ভালো হলেও এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন এই ব্যবসায়ী।
তাহমিনা পারভীন বলেন, রানার প্লাজায় দুটি দোকান ঘরের জন্য তাকে প্রতি মাসে ২২ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। করোনায় সব বন্ধ থাকলেও নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল, সার্ভিস চার্জ, ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আশায় আশায় থেকে ঘরে জমানো টাকা ব্যবসার পেছনে খরচ করেছি। কিন্তু দিন শেষে ফলাফল শূন্য। কারণ এখন মার্কেটে লোকজন নেই। বিক্রিও নেই। কিন্তু পাওনাদারেরা বিভিন্নভাবে প্রেশার দিচ্ছেন টাকার জন্য। অথচ করোনার আগে এখানে জমজমাট ছিল ব্যবসা। ঋণের বোঝায় বেকায়দায় রয়েছেন অনেকেই। মার্কেটে লোকজন না আসলে ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় থাকবে না।'
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে করোনার মধ্যে কর্মচারীদের বেতন ও দোকান ভাড়া দিয়েছেন ফুডকোর্টের চিল ক্যাফে রেস্টুরেন্টের মালিক বিপাশা। তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় এখানে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ব্যবসা শুরুর তিন বছরের মাথায় তিনটি রেস্টুরেন্ট চালু করেছেন বিপাশা। আজ সেই দোকানগুলোই তার গলার কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছে।
বললেন, এই ব্যবসার জন্য একমাত্র ছেলের মোটরসাইকেল বিক্রি করে দোকান ভাড়া দিতে হয়েছে। তবুও করোনার বন্ধ সময়ে সার্ভিস চার্জ ও ভাড়া বাকি রয়েছে প্রায় ৪ লাখ টাকা। এদিকে এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তির জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। মার্কেট রেস্টুরেন্ট খোলা হলেও ক্রেতা নেই। বিক্রি নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুডকোর্টে গত এক বছরে করোনার কারণে পল্লী ভোজন, সাবিতাস কিচেন ও সাব ক্লাব নামে তিনটি রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। এক রেস্টুরেন্টমালিক এই মার্কেট সমিতির লোকজনের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনিও সেই টাকা পরিশোধ না করতে পেরে ফুডকোর্টে যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে ঋণ নেওয়া ওই নারী গণমাধ্যমের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
করোনার থাবা যে এই মার্কেটে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে, তার কিছুটা আভাস পাওয়া গেল টুইস্ট এন্ড টেস্টি রেস্টুরেন্টের মালিকের ছেলে আরহামের (ছদ্মনাম) কথায়। মূলত এই রেস্টুরেন্টের মালিক তার মা ফারহানা আফরোজ। মায়ের অনুপস্থিতিতে কিছুদিন ধরে এই রেস্টুরেন্ট দেখাশোনা করছেন তিনি।
আরহাম বলেন, 'একটা সময় আমাদের দোকানে দিনে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। এখন ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিদিন বিক্রি শেষে মাথায় হাত রাখতে হয়, কারণ এই টাকা দিয়ে কর্মচারী বেতন আর খরচই মিটবে না।'
ফুডকোর্টের ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার আগে এই মার্কেটে দিনে গড়ে সাড়ে তিন লাখ টাকার খাবার বিক্রি হয়েছে। ক্রেতায় ভরপুর থাকত সাততলা। এর মধ্যে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীই বেশি। কিন্তু করোনার একাধিক ঢেউয়ের কারণে পাল্টে গেছে এই মার্কেটের চিত্র। এখন গোটা মার্কেট মিলে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বিক্রিই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফুডকোর্টে বনফায়ার রেস্টুরেন্টের মালিক উম্মে ফাতেমা লিসা। লিসা বলেন, 'প্রথমবার করোনায় এখানকার ব্যবসায়ীরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কারণ তখন রানিং ব্যবসা ছিল। ব্যবসা থেকে পাওয়া লাভের টাকা খরচ করেছেন অনেকে। কিন্তু কয়েকদফা করোনার পর ব্যবসায়ীদের পরিস্থিতি একদম খারাপ হয়ে গেছে। এখন ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত।
'অনেক জায়গায় দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। কিন্তু এখানে কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয়নি।
'তবে এই মার্কেটে একটি সমিত রয়েছে, সেখান থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়। তাদের অবস্থাও খারাপ। এখন তারাও আর ঋণ দিতে চাচ্ছেন না। এই অবস্থা চলতে থাকলে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।'
এখানে ব্যবসায়ীদের ২ শতাংশ হারে ঋণ দেওয়ার সাথে যুক্ত রয়েছেন রেজওয়ান ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। ঋণ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'করোনার কারণে এই মার্কেটের অধিকাংশ ব্যবসায়ী ঋণখেলাপী হয়েছেন। এই কারণে আমরা আমাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি।'
এসব নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের ঋণদানের জন্য কোনো কার্যক্রম বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের আছে কি না জানতে চাইলে সংস্থাটির উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, 'আমরা সাধারণ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের বিষয়গুলো দেখাশোনা করি। তবে সরকারের স্বল্প ঋণে বিভিন্ন ঋণদান কর্মসূচি রয়েছে। কেউ আবেদন করলে বিবেচনা করে দেখা হবে।'