বছরে ২০ বর্গকিলোমিটার ভূমি বাড়ছে বাংলাদেশের
নোয়াখালী উপকূলের চর নাঙ্গুলিয়া। তিন দশক আগেও যা ছিলো বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির অংশ। আজ তা সমৃদ্ধ গ্রামে পরিণত হয়েছে। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রক্ষপুত্রের বয়ে আনা পলিতে গত ১০০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগ হয়েছে চর নাঙ্গুলিয়ার মতোই প্রায় দুই হাজার বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরে গড়ে প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি যুক্ত হচ্ছে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নরত 'চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প-বিজিং' প্রকল্পের এক প্রকাশনায় বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) বরাতে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।
সিইজিআইএস-এর হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশের ৩২ কিলোমিটার ভূমি নদী ভাঙন ও সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও পদ্মা নদী দিয়ে ১০০ কোটি টন পলি বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। এই পলি মাটিতে জেগে উঠছে ৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নতুন চর।
ভাঙা-গড়ার এ খেলায় প্রতি বছরই ২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বাড়ছে বাংলাদেশের মূল্য ভূখণ্ডের। ৩২ বছরের স্যাটেলাইট ইমেইজ বিশ্লেষন করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ১৯১৩ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ১০০ বছরে বঙ্গোপসাগরের নোয়াখালী উপকূল ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রসারিত হয়েছে। মেঘনার ভাঙন থেকে নোয়াখালীকে রক্ষা করতে ১৯৫৭ সালে ও ১৯৬৪ সালে দুটি ক্রসডেম নির্মাণ করা হয়। ফলে পলিমাটি জমে সে অঞ্চল উঁচু হয়ে যায়। আশপাশে জাগতে শুরু হয় নতুন নতুন চর।
১৯৮০ সাল থেকে নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহায়তায় এসব চরে ভূমি উদ্ধার প্রকল্প, চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের অধীনে বঙ্গোপসাগরের বুকে নদীর বালুকণা ও পলিতে গড়া দ্বীপগুলো বর্তমানে সবুজ খামার বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
১৯৯৪ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত গত সাড়ে ২৩ বছরে ৩৬ হাজার ২৮১টি ভূমিহীন পরিবারকে ৮৩ হাজার ৭৯৮ একর খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে সরকার। ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে আরও ৫ হাজার ৭১৯টি ভূমিহীন পরিবারকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সিইজিআইএস-এর রিমোর্ট সেন্সিং ডিভাইস বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, '১৯৭৩ সাল থেকে নোয়াখালী উপকূলে নতুন চর জেগে উঠা নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এর আগের ৩২ বছরের স্যাটেলাইট ইমেইজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার নতুন ভূখণ্ড যুক্ত হচ্ছে। তবে সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও পদ্মা নদী দিয়ে পলি নেমে আসার পরিমাণ কমেছে। একই সঙ্গে নতুন জেগে উঠা চর বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নদী ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন জমি বৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে।'
ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (আইএফএডি) জমি বন্দোবস্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, 'গত ১০০ বছরে নদী ভাঙনে হারিয়ে যাওয়া ১ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশ ভূমি জাগছে সমূদ্র উপকূলে; বাকি ৭ শতাংশ বিভিন্ন নদ-নদীতে। সব মিলিয়ে নতুন জমির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার বর্গকিলোমিটার।'
নোয়াখালীর চর মুজিব আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমার দাদা ছিলেন নোয়াখালীর সোনাপুরের বাসিন্দা। প্রায় ৯০ বছর আগে তিনি চর বদুয়ায় বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই আমার বাবার জন্ম। পরে দক্ষিণে নতুন চর চরভাটা জাগলে জীবিকার তাগিদে সেখানে বসতি গড়েন; সেখানেই আমার জন্ম।'
'কিন্তু ২০ বছর আগে বাবার ক্যানসার চিকিৎসার জন্য চরভাটার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিই। এখন নতুন করে জেগে উঠা চড় মুজিবের আশ্রয়ন প্রকল্পে আমার পরিবারের ঠাঁই হয়,' যোগ করেন তিনি।
২০১০ সালে চর নাঙ্গুলিয়ায় সরকারের দেওয়া ১৫০ শতক জমিতে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন আলাউদ্দিন-বিলকিস দম্পতি। দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা থেকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছিলেন তারা। বর্তমানে তাদের মূলধন প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। এভাবেই গত এক দশকে নোয়াখালীর চান্দিনা ইউনিয়নে অন্তত ৬০০ পরিবার সমৃদ্ধ হয়েছে।
যেভাবে জেগে উঠছে নতুন বাংলাদেশ
ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯১৩ সালে নোয়াখালী উপকূলের তটরেখা ছিল বতর্মান জেলার সোনাপুরের কাছাকাছি। তবে পরের ১০০ বছরে তা ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রসারিত হয়ে কেয়ারিংচর চরে এসে ঠেকে। মূলত মেঘনার ভাঙন থেকে নোয়াখালীকে রক্ষা করতে ১৯৫৭ ও ১৯৬৪ সালে দুটি ক্রসডেম নির্মাণ করা হয়। ফলে পলিমাটি জমে সে অঞ্চল উঁচু হয়ে যায়। আশপাশে জাগতে শুরু হয় নতুন নতুন চর।
এছাড়া ১৯৮৬ সালে ফেনী নদীর মোহনায় মুহুরী বাঁধের কারণে বিশাল চরের বিকাশ ঘটে। গুগল স্যাটেলাইট ইমেজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সীমানা আরও প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে প্রসারিত হয়েছে। মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে জেগে উঠা 'ছোট চর' ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, অচিরেই যা দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মিশে যাবে।
তবে সিইজিআইএস-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে নতুন ভূখণ্ড জেগে ওঠার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্প। ওই ভূমিকম্পে ভূমিধসের ফলে হিমালয় থেকে নদীগুলো বেয়ে বিপুল পরিমাণ পলি নেমে আসতে থাকে। ফলে ১৯৪৩ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতি বছর ৪৩ বর্গকিলোমিটার করে ভূমি জেগে ওঠে। ওই সময়েই নোয়াখালী ও ফেনী জেলার বেশির ভাগ ভূমি গড়ে ওঠে বলে সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে।
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) হিসেবে, ১৭৮০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ২০০ বছরে বাংলাদেশের দক্ষিণে ৬২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন বেড়েছে। পরের ৪১ বছরে ভূমি উদ্ধার প্রকল্প ও চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন করা হয়েছে আরও ৮৩ হাজার ৭৯৮ একর জমি।
গত ১০০ বছরে নতুন জেগে উঠা চরের তালিকায় রয়েছে- নোয়াখালী উপকূলের নিঝুমদ্বীপ, নলেরচর ও কেয়ারিংচর; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলারি উত্তর-পশ্চিমে উড়ির চর ও ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ভাসানচরসহ অনেক দ্বীপ।
প্রায় দুই দশক আগে জেগে ওঠা ভাসানচরে ইতোমধ্যেই ১৮,৩৪৭ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। ভাসানচরের দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে জেগেছে ১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের গাঙ্গুরিয়ার চর। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে গাঙ্গুরিয়ার চরে চাষাবাদ শুরু হবে বলে স্থানীয়রা আশা করছেন।
মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় যে পরিমাণ ভূমি বিলীন হচ্ছে, বিপরীতে এর চারপাশে অন্তত ১০ গুণ ভূমি জেগে উঠছে। এছাড়া হাতিয়ার পশ্চিমে নতুন করে জেগে উঠেছে ঢালচর, চর মোহাম্মদ আলী, চর ইউনুস, চর আউয়াল, মৌলভীরচর, তমরুদ্দিরচর, জাগলারচর, ইসলামচর, নঙ্গলিয়ারচর, সাহেব আলীরচর; দক্ষিণে কালামচর।
এছাড়া হাতিয়া নদীতে সাতটি চর জেগেছে। এর মধ্যে কলাতলী, তেলিয়ার চর, বদনার চর, ঢাল চর ও মৌলভীর চরে বনায়ন ও চাষাবাদ চলছে। আগামী এক দশকে এসব চরের আয়তন দাঁড়াবে প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার।
হাতিয়ার উত্তরে গত দেড় দশকে জেগেছে ইসলাম চর, জাহাইজ্জার চর, সাহেব আলীর চরসহ অন্তত ১৫টি দ্বীপ। এ ছাড়া উড়ির চরের পাশেও কয়েকটি চর জাগছে। এসব চরের কোনোটি জোয়ারে ডুবে যায়, ভাটায় আবার ভেসে উঠে। কোনোটির কিছু অংশ জোয়ারেও ডোবে না। একটু পানির নিচে থাকা নতুন করে জেগে ওঠা এমন ৩০-৪০টি ডুবোচর রয়েছে, যেগুলো পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে জেগে ওঠার রয়েছে অপেক্ষায়।
এছাড়া বরিশাল, খুলনাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের বুক চিড়ে জেগে উঠছে নতুন নতুন ভূখণ্ড। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব চরের ভূমির পরিমাণ হবে প্রায় ৩৩ হাজার বর্গকিলোমিটার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'সিইজিআইএস ও ভূমি মন্ত্রণালয় যে তথ্য দিয়েছে, আমাদের গবেষণায়ও এর সত্যতা পেয়েছি। তবে একটি অনুকূল পরিবেশে যেভাবে চরগুলো গড়ে উঠছে, তেমনি সামান্য পরিবর্তনজনিত কারণে এগুলো বিলীনও হয়ে যেতে পারে।'
'তাই কয়েক দশকে জেগে উঠ চরগুলোকে সংরক্ষণে হার্ড ও সফট- দুটো পদ্ধতিই অনুসরণ করা যেতে পারে। একেবারের শুরু কাজ হচ্ছে, জর জাগলে সেখানে বনায়ন করতে হবে; এটা সফট পদ্ধতি। এ কাজে ম্যানগ্রোভ বনায়ন কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এছাড়া নেদারল্যান্ডস বা সিঙ্গাপুরের মতো ক্রসড্যাম আর প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া হলে কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের উপকূলে জেগে ওঠা ভূমির আয়তন দাঁড়াবে প্রায় ১৫ হাজার বর্গমাইল,' যোগ করেন তিনি।