মানবজাতি তামাকের নেশায় বুঁদ ১২,৩০০ বছর ধরে
এতদিন ভাবা হতো, মানুষের তামাক ব্যবহারের সূচনা ঘটেছে বুঝি প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইউটায় মরুভূমির মধ্যে ইউএস এয়ার ফোর্সের ঘাঁটিতে একটি প্রাগৈতিহাসিক স্থানে পাওয়া গেছে এমন কিছু নিদর্শন, যার ফলে বদলে গেছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অতীতের সব হিসাব-নিকাশ। তারা এখন ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, সাড়ে তিন হাজার নয়, সেই ১২,৩০০ বছর আগে থেকেই তামাক ব্যবহার করতে শুরু করেছে মানবজাতি।
বর্তমানে সামরিক পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত ওই প্রাগৈতিহাসিক স্থান থেকে পাওয়া গেছে চারটি পোড়া তামাকের বীজ। এ থেকে গবেষকরা অনুমান করছেন, এ অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী প্রাচীন জনগোষ্ঠীরা শুকনো তামাক চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল।
গত সোমবার 'ন্যাচার হিউম্যান হিহেভিয়ার' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণা নিবন্ধটি, যেখানে তামাক ব্যবহার ও এর চাষের ইতিহাসের ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে। নিবন্ধটির রচয়িতারা মনে করছেন, আমেরিকা অঞ্চলে তামাক গাছের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই মানুষ নিকোটিনে আসক্ত হয়ে পড়ে।
গবেষণাটির নেতৃত্বে ছিলেন ড্যারন ডিউক। তিনি ফার ওয়েস্টার্ন অ্যানথ্রোপলজিক্যাল রিসার্চ গ্রুপের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। ২০১৫ সালে সল্ট লেক সিটির পশ্চিমে অবস্থিত ইউটা টেস্ট অ্যান্ড ট্রেনিং রেঞ্জে জরিপ চালানোর সময় তারা উদঘাটন করেন এমন একটি স্থান, যেটিকে প্রাগৈতিহাসিক শিকারী-সংগ্রাহকরা ব্যবহার করত উন্মুক্ত শিবির হিসেবে।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা জায়গাটির নাম দেন উইশবোন সাইট, কেননা সেখানে তারা ওয়াটারফাউল পাখির শত শত হাড় খুঁজে পান। ধারণা করা যেতে পারে, ওই হাসঁজাতীয় পাখিগুলোই হয়তো ছিল আদিম অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য।
জায়গাটি থেকে প্রাপ্ত উন্মুক্ত চুলায় যে রেডিওকার্বন পাওয়া গেছে, সেগুলো প্রায় ১২,৩০০ বছর আগেকার। ফলে এটিই এখন পর্যন্ত গ্রেট বেসিন অঞ্চলে প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন উন্মুক্ত চুলা। আর সে কারণেই প্রাগৈতিহাসিক স্থানটির রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। কিন্তু তারপরও গবেষকরা যখন সেখান থেকে চারটি পোড়া তামাকের বীজ উদঘাটন করেন, এতে তারা কিছুটা যেন অবাকই হন।
এক সাক্ষাৎকারে ডিউক জানান, এমন কোনো কিছুর সন্ধান পাওয়ার জন্য তারা একদমই প্রস্তুত ছিলেন না। এমনকি ওই স্থানের চেয়েও অনেক কম বয়সী স্থানেও তারা তামাকের বীজ পাওয়ার আশা করতেন না। কেননা এত আগে থেকেই যে মানুষ তামাক ব্যবহার করত, সেটি তারা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি।
এই নতুন আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত সর্বপ্রাচীন হিসেবে বিবেচিত তামাকের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল ৩,৩০০ বছর বয়সী একটি স্মোকিং পাইপে। সেই পাইপটির প্রাপ্তিস্থান ছিল নর্দার্ন অ্যালাবামা।
এছাড়া পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া গেলেও, গবেষকদের মোটামুটি আন্দাজ ছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই হয়তো তামাক দিয়ে ধূমপান করা হতো। তবে প্রমাণ হিসেবে সেখানে পাইপ পাওয়া গেলেও, নিকোটিনের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়নি।
এখন গবেষকদের মনে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো, উইশবোন সাইটে প্রাপ্ত তামাকের বীজগুলো কি কোনো প্রাকৃতিক কারণে পুড়েছিল, নাকি নিকোটিন ব্যবহারের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো কারণে পোড়ানো হয়েছিল।
বর্তমানে গ্রেট সল্ট লেকের মরুভূমি মূলত একটি নির্জন সমতলভূমি, যেটি প্রধানত ব্যবহৃত হয় সুপার-ফাস্ট কার রেসিং এবং বোমা পরীক্ষার জন্য। তবে যেমনটি নাম থেকেই বোঝা যায়, এই মরুভূমি অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক কালে ছিল একটি প্রকাণ্ড হ্রদ। কিন্তু সর্বশেষ বরফ যুগের শেষে যখন জলবায়ু উষ্ণ হতে শুরু করে, তখন হ্রদটিও শুকিয়ে যেতে শুরু করে। পরের কয়েক সহস্র বছর ধরে এটি পরিণত হয় প্রাগৈতিহাসিক শিকারী-সংগ্রাহকদের বসবাসের একটি আদর্শ স্থানে।
তবে এমন আর্দ্র আবহাওয়ায় তামাকের জন্মাবার কথা নয়। কেবল উইশবোন সাইট থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরবর্তী জঙ্গলেই তা সম্ভব ছিল। যদিও তামাক গাছের বীজ আকারে ছোট, তবে এত বেশিও ছোট নয় যে অত দূর থেকে সেগুলো বাতাসে উড়ে চলে আসবে এই স্থানে। তাই অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে কোনো মানুষ বা অন্য পশুপাখিই জঙ্গল থেকে এখানে বয়ে এনেছিল তামাকগুলো।
গবেষকরা এমন সম্ভাবনার কথাও বিবেচনা করে দেখেছেন যে হতে পারে বীজগুলো আসলে ওয়াটারফাউলের পেটে ছিল। পাখিগুলোকে যখন খাওয়ার জন্য রোস্ট করা হয়েছে, তখনই বীজগুলোও পুড়ে গেছে। তবে ওই পাখিগুলো যে তামাক খাবে সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কোনো সাধারণ হাঁস তো তামাক খায় না। তাছাড়া ওয়াটারফাউলের খাবারের সঙ্কটে পড়বারও কথা নয়, যে কারণে তাদের তামাক খেয়ে জীবনধারণ করতে হবে।
এদিকে তামাক গাছকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনাও একদম নেই বলেই চলে। কেননা অন্যান্য অধিকাংশ আগাছার মতোই, তামাক গাছেও কোনো কাঠের ন্যায় অংশ নেই। ফলে এরা ভালো জ্বালানি নয়, খুব দ্রুতই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তাছাড়া ওই অঞ্চলের আশেপাশে মানুষের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের মতো অন্য অনেক গাছগাছালিও ছিল।
এদিকে উইশবোনে খুঁজে পাওয়া বীজগুলো হলো নিকোটিয়ানা অ্যাটেনুয়াটা প্রজাতির। এই বুনো তামাকে প্রচুর পরিমাণে নিকোটিনের অস্তিত্ব রয়েছে। কেবল কৃত্রিমভাবে জন্মানো প্রজাতিতেই এর চেয়ে বেশি নিকোটিন পাওয়া যায়। কিন্তু তখনকার দিনে তো কৃত্রিমভাবে তামাকের চাষ সম্ভব ছিল না।
তাই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা হলো এই যে, তামাকের বীজগুলো ব্যবহৃত হতো এমন সবজি উপকরণ হিসেবে যাকে চুষে খাওয়া হতো। ডিউক ও তার সহকর্মীরা এই ব্যাখ্যাকেই তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ধূমপানের জন্য তামাক ব্যবহারের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে পাইপের প্রয়োজন ছিল। অথচ কোনো পাইপের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা যায়নি।
জানিয়ে রাখা ভালো, তামাকের বীজে কিন্তু নিকোটিন থাকে না। নিকোটিন থাকে তামাকের পাতায়, যেটি এ গাছের আসক্তি সৃষ্টিকারী অংশ।
উইশবোন সাইটে যে ধরনের যন্ত্রপাতির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে বলা যায় যে এখানে বাস করত তথাকথিত হ্যাসকেট সংস্কৃতির মানুষেরা। এই হ্যাসকেট সংস্কৃতি ক্লোভিস সংস্কৃতির চেয়ে তুলনামূলক নবীন, এবং এটির ব্যাপ্তিও ছিল ক্লোভিস সংস্কৃতির চেয়ে কম।
একসময় বিশ্বাস করা হতো, ক্লোভিসরাই হলো ইউরেশিয়া থেকে উত্তর আমেরিকায় আসা প্রথম জাতি। প্রায় ১৪,০০০ বছর আগে বেরিংগিয়া ভূমি সেতু থেকে আমেরিকায় এসেছে তারা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ক্লোভিসদের চেয়েও আরও অন্তত কয়েক হাজার বছর আগেই আমেরিকায় পা রেখেছে মানুষ। তবু ক্লোভিস ও তাদের আগে-পরের জাতিগুলোর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে আধুনিক নেটিভ আমেরিকানদের ইতিহাস পুনরুদ্ধারে।
আমরা এখনও নিশ্চিত করে জানি না যে হ্যাসকেটরা তামাক কী কাজে ব্যবহার করত। তবে এই ব্যাপারটি ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে আসছে যে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষরা কিছু নির্দিষ্ট গাছের চিকিৎসা ও অচিকিৎসা জনিত ব্যবহার সম্পর্কে বেশ ভালো রকমেরই ওয়াকিবহাল ছিল।
হতে পারে উইশবোনে তামাকের কোনো ঐতিহ্যগত গুরুত্ব ছিল। আবার এমনও হতে পারে যে এই তামাকের নিকোটিন তৎকালীন ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত শিকারী-সংগ্রাহকদের শক্তি ও মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য এক ধরনের উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মানুষের সঙ্গে তামাকের সম্পর্কের সঠিক ইতিহাস জানা প্রয়োজন এ কারণে যে, এর মাধ্যমেই হয়তো এক সময় জানা যাবে যে শেষ পর্যন্ত ছয় থেকে আট হাজার বছর আগে আন্দেজে ইন্ডিয়ান আমেরিকানরা কেন খাওয়ার অযোগ্য, বিষাক্ত এক আগাছা চাষ শুরু করেছিল।
ইউরোপিয়ানরা আমেরিকায় পৌঁছানোর পর থেকেই তামাক চাষ ও বাণিজ্য বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি বড় চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়। এবং তারই ধারাবাহিকতায় আধুনিক সময়ে সেই বিষাক্ত আগাছা বা গাঁজা পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও অপব্যবহৃত উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী নেশাদ্রব্যে।
- সূত্র: হারেৎজ